Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলাদেশি শ্রমিকের শেষ ইচ্ছা পূরণ করলেন সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা

ranaকরোনাকালীন আমরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে উঠছি, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সন্ধি করে নতুন পৃথিবী দেখার অপেক্ষা করছি ঠিক এমনি এক মুহূর্তে সিঙ্গাপুর শিপইয়ার্ডে কাজ করা ৩৪ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে।

তার চোখে ছলছল করছে মহাসমুদ্রের জল। বুকে বইছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঘূর্ণিঝড়টি। আমরা কী উপলব্ধি করতে পারি সেই মানুষটির অনুভূতি। আর এই মৃত্যু পথযাত্রী প্রবাসী শ্রমিকের শেষ ইচ্ছে পূরণ করে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সিনথিয়া গুহ এবং তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে কিছু মানুষ।

কিছু কিছু ঘটনা সভ্যতা পরিবর্তনের জন্য ঘটে। যা প্রতিটা মানুষের হৃদয়কে কোমল ও স্বচ্ছ করে। যা শুনলে অন্তর কেঁদে উঠে। ভেদাভেদ ভুলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা বেড়ে যায়। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। মানবতার অমর দৃষ্টান্ত হয়ে শতশত বছর মানুষকে আলোকিত করে। মানবতার শিক্ষা দিয়ে যায়।

সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে ঘটে যাওয়া এমনই একটি ঘটনা আমার হৃদয়ে তোলপাড় হয়েছে। চোখে জল এসেছে। বারবার নিজের সন্তানের কথা এবং পরিবারের কথা মনে পড়েছে। এই দেশের চিকিৎসকরা একটা অসুস্থ মানুষের চাওয়া পাওয়াকে এতটা মূল্যায়ন করতে পারে আমি ভাবতেই পারিনি। সত্যিই তারা মহান।

জানা গেছে, গত এপ্রিলের মাঝামাঝিতে শিপইয়ার্ড শ্রমিক রানা সিকদার পেটে প্রচন্ড ব্যথা এবং বারবার বমি করায় জরুরিভাবে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। সেখানের চিকিৎসকরা বিভিন্ন পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে, তার পাকস্থলীতে ক্যানসার হয়েছে এবং তা সারা পেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

এদিকে সিঙ্গাপুরে সার্কিট ব্রেকার চলছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ। বাংলাদেশেও লকডাউন। অজানা ভয়ে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠে রানা সিকদারের। তবে কি এই হাসপাতালের বেডেই তাকে একাকিত্বের যন্ত্রণা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে? বারবার তার মায়ের আঁচলের গন্ধ পেতে মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠে। ছেলে মাহিমের আদরমাখা মুখটা মনে পড়ে। তার ছোট্ট দেহটাকে আদর করার জন্য বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠে।

দীর্ঘ একমাস মেডিকেল টিম এই খেটে খাওয়া শ্রমিককে গভীর মমতায় নিবিড় চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। ক্যানসারের চতুর্থ ধাপে থাকা একজন নিরীহ শ্রমিককে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ডা. সিনথিয়া একদিন তার চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় রানা সিকদার তাকে মিনতি করে বলেন ‘যেহেতু আমি আর বেশিদিন বাঁচব না তাহলে আমাকে আমার সন্তান ও পরিবারের কাছে দেশে পাঠিয়ে দিন। আমি তাদের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই’।

ডা. সিনথিয়ার হৃদয়ে এই ছোট্ট কথাগুলো ব্যাপক আলোড়িত হয়। তার মন ভিজে যায়। তাই একজন মৃত্যু পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। তার এই মানবিক উদ্যোগকে স্বাগতম জানিয়ে হাসপাতালের আরও অনেকেই এগিয়ে আসেন।

এদিকে কোভিড-১৯ এ দেশকে মহামারি থেকে রক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর সরকার জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবককর্মী ছাড়া সারা বিশ্বের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। ডা. সিনথিয়া শুরু করেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মানুষদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ। কিভাবে এই অসুস্থ প্রবাসীযোদ্ধাকে বাংলাদেশে তার পরিবারের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া যায়।

যখন মানবিক তদবীর করে সরকার থেকে যাতায়াতের অনুমতি মিললো তখন শুরু হয় অর্থ জোগাড় করা। কারণ তাকে প্রাইভেট বিমানে পাঠাতে হলে যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। শুরু হয় ডা. সিনথিয়ার আবারও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে টাকা জোগাড় করা। তৈরি করেন তহবিল। অবশেষে সার্থক হয় তার এই মহতি উদ্যোগ।

সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন পেশাদার মানুষ সেই তহবিলে যে যা পেরেছেন জমা দিয়েছেন। মাত্র দুই দিনেই সেই লক্ষমাত্রা পূরণ হয়। জমা হয় ষাট হাজার ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। কথায় আছে সৃষ্টিকর্তার কাছে কেউ মন থেকে কিছু চাইলে সেই আশা পূরণ হয়।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যখন নিজেদের গোছাতে ব্যস্ত ঠিক এমনই সময় সিঙ্গাপুরের মানুষেরা তৈরি করেছে এই অভিভূত হওয়া মানবিকতার গল্প। সকল প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে একজন সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকের মৃত্যু পথযাত্রায় তারা যেই উদারতা দেখিয়েছেন তা সত্যিই সারা বিশ্বে প্রতিটা শ্রমিকের অন্তরে তা অলংকার হয়ে থাকবে।

অবশেষে তেরো বছর প্রবাস জীবনের ইতি টেনে গত ২২ মে মধ্যরাতে প্রাইভেট বিমান চার্টার্ড এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দুইজন ডাক্তারসহ রানা সিকদার বাংলাদেশে রওনা হন। পেছনে পড়ে থাকে তার রক্তে ঘামে মিশে থাকা স্বপ্নের শহর সিঙ্গাপুর। রানা সিকদার দেশে পৌঁছে যখন তার ছোট্ট ছেলেকে বুকে টেনে নেবে কিংবা সে তার বৃদ্ধা মাকে জড়িয়ে ধরবে, পৃথিবীটা নিশ্চয়ই ভালোবাসার প্লাবণে প্লাবিত হবে।

শরীফ, সিঙ্গাপুর প্রবাসী

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email