Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সভ্যতার অমর নায়ক ইবনে সিনা

এম এ নাছের, ২২ জুন ২০১৪:

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, যেন জ্ঞানের রাজ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন সারা বেলা। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও রাজকীয় ভোগবিলাস আর আরাম-আয়েশ থেকে জ্ঞানের রাজ্যেই বিচরণ করতে বেশি ভালোবাসতেন তিনি। বলছিলাম মুসলিম সভ্যতা বিনির্মাণে শ্রেষ্ঠ এক জ্ঞানযোদ্ধার কথা, যিনি একাধারে একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গণিতবিদ এবং সমসাময়িক অন্যান্য জ্ঞানভান্ডারের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ পন্ডিত। যিনি ছিলেন মুসলমানদের গৌরব। তিনি হলেন ইবনে সিনা; আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা তার পুরো নাম।

chardike-ad
2_80460
ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ কানুন ফিততিবে অঙ্কিত এনাটমি

তিনি ৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট , ৩৭০ হিজরির সফর মাসে বর্তমান উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসান নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন একজন রাজ কর্মচারী আর মমতাময়ী মা সিতারা বেগমের আদর-স্নেহে রাজকীয় পরিবেশেই বেড়ে উঠতে থাকেন এ জ্ঞানবোদ্ধা। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি বাবার হাত ধরে চলে আসেন বোখারায় এবং এখানেই সূচনা করেন শিক্ষা জীবনের প্রথম পাঠ।

ফারসি ইবনে সিনার মায়ের ভাষা হলেও তিনি আরবি ভাষাকেই অন্যদের মতো জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে অাঁকড়ে ধরেন। তার প্রতিভার স্বাক্ষর তিনি ছোটবেলায়ই দিয়েছিলেন; মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি পুরো কোরআন ঠোঁটস্থ করে ফেলেন। আর এর আগেই তিনি ফারসি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। তিনি এ ভাষায় কিছু গ্রন্থ ও কবিতা রচনা করেছিলেন। বিভিন্ন বিদ্যার প্রতি তার অনুরাগ সৃষ্টি হয় ইসমাঈলীয়দের সঙ্গে মেলামেশার ফলে; ইসমাঈলীয়রা তার পিতার কাছে প্রায়ই যাতায়াত করত। ইবনে সিনার উন্নত জ্ঞানচর্চার পেছনে তার বাবার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা ছিল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকস্বরূপ। বাবাই তাকে জ্ঞানী ও পন্ডিত শিক্ষকদের সংস্পর্শে জ্ঞান সাধনার সুযোগ করে দিতেন। ইবনে সিনার শিক্ষাজীবন মূলত গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে। তিনি ইসমাঈল সুফি, মাহমুদ মাসসাহ এবং দার্শনিক আল না’তেলির সংস্পর্শে জ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে চষে বেড়ান দাপটের সঙ্গে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহশাস্ত্র, গণিত, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির আল মাজেস্ট এবং জাওয়াহেরে মান্তেক খুব কৃতিত্বের সঙ্গেই আয়ত্ত করে ফেলেন। এরপরই তিনি মনোযোগ দেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে; চিকিৎসাবিজ্ঞানে তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

বলা হয়ে থাকে যে, যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল না তখন হিপোক্রেটস তা সৃষ্টি করেন; যখন তা মরে গিয়েছিল তখন তা পুনরুজ্জীবিত করেন গ্যালেন; যখন তা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন আলরাজি এ বিজ্ঞানকে সুসংঘবদ্ধ করেন আর ইবনে সিনা একে পরিপূর্ণতা দান করেন। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি দিবারাত্রি এ বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। নিদ্রাকর্ষণ যেন তার অধ্যয়নে বাধার দেয়াল তৈরি করতে না পারে তাই তিনি নিদ্রা প্রতিরোধক কিছু পান করতেন। এভাবেই তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের সমস্যাগুলো সমাধান করছেন একের পর এক। কখনও জেগে আবার কখনওবা নিদ্রা অবস্থায়। ১৮ বছর বয়সে তিনি বোখারার শাসক নূহ ইবনে মানসুরের চিকিৎসায় পূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। এ সূত্রে তিনি বাদশাহি গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। এখানে তিনি নিজের অতুলনীয় স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও বোধশক্তির সাহায্যে বিদ্যার্জনে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেন।

ইবনে সিনার জীবনীকার ইবনে খালি্লকান বলেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ইবনে সিনার কাছে মশহুর চিকিৎসাবিদরা চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ও তার অভিনব চিকিৎসা প্রণালিতে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন। যে স্নেহময়ী পিতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভালোবাসায় জ্ঞানসাগরের অতল পথ পাড়ি দিয়েছেন খুব সহজে, সময়ের একালে এসে তা কিছুটা বন্ধুর হয়ে ওঠে তার জন্য; মাত্র ২০ বছর বয়সে সে অন্তহীন স্নেহময়ী পিতাকে হারান। শুরু হয় এক নতুন জীবন। তার জীবনে যেমন অজস্র খ্যাতি জুটেছে, আবার ভাগ্য বিড়ম্বনার টানাপড়েনেও তাকে কম বিব্রত হতে হয়নি। গজনির সুলতান মাহমুদের অনুগ্রহ অস্বীকার করে ইবনে সিনা গুর্গান, হামাদান ও ইস্পাহানে পলায়ন করেছেন। আবার তিনি বুয়ায়িদ সুলতান শামসউদ্দৌলা ও পরে শাহান শাহ আলাউদ্দৌলার মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি অবদান রেখেছেন তা যেমন সত্য, তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞান যে তার কাছে চিরঋণী তাও অস্বীকার করার কোনো জো নেই।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার প্রসিদ্ধ পুস্তক ‘আলকানুন ফি আলতিব্ব’ সংক্ষেপে ‘আলকানুন’ চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞানের একটি বৃহৎ, ব্যাপক এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিণত রচনা। এতে প্রাচীন ও সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে ইসলামী আমলে লব্ধ জ্ঞান অত্যন্ত পরিশ্রম করে সুশৃঙ্খলভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণে এ পুস্তক প্রকাশের পর গ্যালেন, রাজি এবং আলী ইবনে আব্বাসের রচনাবলির ব্যবহার পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এ গ্রন্থ প্রাচ্য-প্রতিচ্যের সবস্থানেই পরবর্তী ৬০০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপনা কানুনের ভিত্তিতে হতো। ইউরোপে এ পুস্তক ঈধহহড়হ গবফরপরহধ নামে প্রসিদ্ধ। মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কারের প্রায় ৩০ বছর পর ১৪৭৬ সালে তা চার খন্ডে মুদ্রিত হয় রোমে। এ গ্রন্থটি ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশি। তিনি এ গ্রন্থে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

প্রকৃতপক্ষে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক তিনিই। তিনি মানুষের কল্যাণ আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে আজীবন পরিশ্রম করে গেছেন এবং জ্ঞানের সন্ধানে ভ্রমণ করেছেন নানা স্থান। জীবন সায়াহ্নে ফিরে আসেন হামাদানে। অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে তিনি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়েন এবং পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। একদিন তার ভৃত্য ওষুধের সঙ্গে আফিম মিশিয়ে দিলে আফিমের বিষক্রিয়ায় তার জীবনীশক্তি শেষ হয়ে আসে। ফলে ২১ জুন ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ, ৪ রমজান ৪২৮ হিজরি মুসলিম সভ্যতার এ শ্রেষ্ঠ নায়ক ইন্তেকাল করেন। হামাদানে তার মাজার এখনও বিদ্যমান আছে।