নারীর জন্য নিরাপদ শহরের বেশ কয়েকটি সূচক আছে। এসব সূচকের কোনো কোনোটিতে নারী তো বটেই, পুরুষের জন্যও নিরাপদ নয় ঢাকা।
প্রথমেই আমরা দেখে নিই নারীর জন্য নিরাপদ শহরের সূচকগুলো কী কী : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ, গণপরিবহন, স্বাস্থ্য, চাকরি, বিনোদন, আবাসন। এই সূচকগুলোর আলোকে এবার দেখা যাক, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলকে কী করে নারীবান্ধব এক শহরে পরিণত করল নগর কর্তৃপক্ষ। কয়েক বছর আগেও কিন্তু সিউল অতটা নারীবান্ধব শহর ছিল না। এ জন্য ২০০৭ সালের জুলাইয়ে ‘উইমেন ফ্রেন্ডলি সিটি প্রজেক্ট’ (ডাব্লিউএফসিপি) নামের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে সিউল নগর কর্তৃপক্ষ। হাতেনাতে ফল। সাম্প্রতিক সব জরিপেই এখন সেরা নারীবান্ধব শহরের তালিকায় প্রথম দিকে সিউল থাকে।
প্রথমেই নারীদের জন্য নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে সিউল। এ জন্য শিশু শ্রেণি থেকেই নারীর অধিকার বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করে তারা। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে এ উদ্যোগ। এর পরও কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তদন্ত থেকে অপরাধ প্রমাণ এবং অপরাধীর শাস্তি-সবই হয় খুব দ্রুত। আর যে নির্যাতনের শিকার হয়, তাকে মনোবিদের মাধ্যমে কাউন্সেলিং ছাড়াও সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হয়। এ জন্য কেউ নির্যাতনের শিকার হলেও সেটা না লুকিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সাহস পায়।
অনেক ক্ষেত্রে নিজের পরিবারেও নারীরা নিরাপদ বোধ করে না। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এটা আরো বেশি সত্যি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশের বিবাহিত মেয়েদের ৮৭ শতাংশই নিজের ঘরে নির্যাতনের শিকার। সরকারি পরিসংখ্যানেই যদি এ অবস্থা, বাস্তবে এ চিত্র না জানি কত ভয়ংকর! পারিবারিক নির্যাতনের শিকারদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় আড়াই শ ‘কাউন্সেলিং সেন্টার ফর ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’ চালু আছে। আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি ঢাকায়ও নারীদের জন্য এ রকম পরামর্শকেন্দ্র চালু করা দরকার।
২০১২ সালে বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান ৫৭.৩০ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো নারীবান্ধব নয়। আর যৌন হয়রানি তো আছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। কলা ভবনের শুধু নিচতলা আর চতুর্থ তলার কমনরুমে মেয়েদের টয়লেট আছে, যা খুবই অপর্যাপ্ত। প্রতিটি তলায়ই মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত ও পরিচ্ছন্ন টয়লেট থাকা দরকার। সভ্য কোনো দেশেই এটা অকল্পনীয়। সিউলের উইমেন ফ্রেন্ডলি সিটি প্রজেক্টের আওতায় সব প্রতিষ্ঠানেই ১ঃ১ অনুপাতে মেয়েদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। সেখানে মেয়েদের জন্য চেঞ্জরুম, বেবিরুম, নার্সিংরুম, ইমার্জেন্সি বেলসহ নানা সুবিধার কথা বলা হয়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন অফিসেই মেয়েদের টয়লেটের অবস্থা ভয়াবহ। আর রাস্তার পাবলিক টয়লেটের কথা আলোচনা না করাই ভালো।
সরকারি নির্দেশনা থাকলেও ঢাকায় অনেক প্রতিষ্ঠানই মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে চায় না। আমার এক আত্মীয়ই ছুটি না পেয়ে আইসিডিডিআরবির চাকরি ছেড়েছেন। এ রকম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানেই যদি এ অবস্থা হয়, সাধারণ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
ডাব্লিউএফসিপি বাস্তবায়নের আগে একটি বিশেষজ্ঞ দল সিউলের রাস্তায় নারীর নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করে। পাবলিক প্লেসে নারীরা কতটা নিরাপদ, গণপরিবহনে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা আছে ইত্যাদি সব দিকই খতিয়ে দেখে তারা। সেই দল সিউলের ৩৫৯টি পার্কিং আর রেস্টরুমকে নারীবান্ধব ঘোষণা করে। অনেক পার্কিং জোনেই গোলাপি রং করে নারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। চালু হয় নারীবান্ধব বিশেষ ট্যাক্সি যাতে ওঠামাত্রই যাত্রার স্থান, সময়, ট্যাক্সি নম্বর প্লেট এসএমএসের মাধ্যমে যাত্রীর পরিবারের কাছে চলে যায়। এভাবে সিউলে রাতে চলাচলকারী নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাস, মেট্রো সার্ভিস তো আছেই, পুরো সিউলের ফুটপাতে নারীরা যাতে স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে, এ প্রকল্পের আওতায় সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
ঢাকা শহরে পাবলিক বাসে ওঠা মেয়ে তো বটেই, পুরুষের জন্যও বড় যুদ্ধ। ওঠার পরই ড্রাইভার, হেলপার বা অন্য যাত্রীদের থেকে আপত্তিকর মন্তব্য শুনতে হয়। অনেক বাস তো ভিড় থাকলে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করা আসনে পুরুষদের বসিয়ে নেয়। ‘সিট নাই’ অজুহাতে মেয়েদের বাসে নেয় না। সকাল বা বিকেলে বাসস্টপে দীর্ঘ লাইনে মেয়েদের অপেক্ষার দৃশ্য আমাদের গা-সওয়া। পরিবহন সমস্যার কারণে অনেক নারীই চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকায়ও নারীদের জন্য বিশেষ বাস আছে, তবে সংখ্যার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ট্যাক্সি বা সিনএনজিতে কোরিয়ার মতো পদ্ধতি চালু করা যায়। সংশ্লিষ্ট বাসস্টপের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারে। তবে সবচেয়ে আগে ব্যক্তিগত পরিবহন কমিয়ে ব্যাপক মাত্রায় গণপরিবহন বাড়ানো দরকার।
অন্য অনেক কিছুর মতোই ঢাকায় বিনোদনব্যবস্থাও ভালো নয়। ঘোরার জন্য পার্ক নেই পর্যাপ্ত। আর যা আছে, তাতেও নারীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার। বেশির ভাগ সিনেমা হলেই একা মেয়েদের যাওয়ার পরিবেশ নেই। অন্য দর্শকদের কটূক্তি তো আছেই, এসব হলের টয়লেটসহ অন্যান্য সুবিধাও ভয়াবহ। অনেক বিপণিবিতান আর বিনোদনকেন্দ্রও যৌন হয়রানির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। নারী সঙ্গী নিয়ে কনসার্ট বা কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়।
ডাব্লিউএফসিপি বাস্তবায়নের পরে সিউল নগর কর্তৃপক্ষ এখন নিয়মিত নারীদের জন্য বিশেষ কনসার্টসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে নারী একা বা সন্তান নিয়ে যায়। এসব অনুষ্ঠানে থাকে খাওয়ার ব্যবস্থা, টিকিটের দাম হয় খুবই কম। ঢাকায় মেয়েদের বিনোদনের ব্যবস্থা খুবই কম। বাস্তবতা বিবেচনায় সরকার এখানেও এমন ব্যবস্থা করতে পারে। এ ছাড়া প্রতিটি সিনেমা হলে সপ্তাহের কোনো এক দিন শুধু মেয়েদের জন্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারে।
সাধারণ সব মানুষের জন্যই ঢাকার চিকিৎসাব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, নারীর অবস্থা তো আরো খারাপ। সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিবেশ এতই নোংরা যে গেলে আরো কয়েকটি রোগের সংক্রমণ নিয়ে ফিরতে হতে পারে। আর বেসরকারি হাসপাতাল অনেকের সামর্থ্যের বাইরে। খরচ অনুযায়ী এসব হাসপাতালের সেবার মানও ভালো নয়। ডাব্লিউএফসিপির আওতায় সব নারীর জন্য স্বাস্থ্য ও মেডিক্যাল সহায়তা নিশ্চিত করেছে সিউল শহর। এর আওতায় নারীরা সহজেই শারীরিক, মানসিকসহ সব ধরনের সাহায্য পায়।
নির্যাতিত নারীদের কাছে ঢাকা দুঃস্বপ্নের মতো। নির্যাতনের শিকার একজন নারীকে পুলিশি সহায়তা, মেডিক্যাল সহায়তা-সব ক্ষেত্রেই অবমাননার শিকার হতে হয়। এ জন্য ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন চালু করা যেতে পারে। নারীরা যেকোনো সমস্যায় সেখানে ফোন করে সহায়তা পাবে। নির্যাতিতদের জন্য থাকবে আশ্রয়কেন্দ্র ও ওয়ানস্টপ সাপোর্ট সেন্টার, যেখানে এক জায়গা থেকেই মেডিক্যাল, আইনি থেকে শুরু করে সব সহায়তা পাওয়া যাবে।
নারীদের কর্মক্ষেত্রে আকৃষ্ট করতে ‘মম ইজ এক্সাইটেড’ প্রকল্প হাতে নেয় সিউল। এখানে নারীদের বিভিন্ন প্রফেশনাল ডিগ্রি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এসব নারীর সন্তানদের জন্য করা হয় নানা সুবিধাসম্পন্ন ডে কেয়ার সেন্টার। চালু করা হয় ‘উইমেন সিইও একাডেমি’ নামের পরামর্শকেন্দ্র। এ ছাড়া আছে ‘হোপ কল’ সার্ভিস, যেখানে ফোন করে নারীরা পেশা সম্পর্কে নানা পরামর্শ পেয়ে থাকে। ফলে নারীরা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজে আসছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ৩০ হাজারেরও বেশি নতুন নারী কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছে। সব মিলিয়ে উইমেন ফ্রেন্ডলি সিটি প্রজেক্ট বাস্তবায়নের পর সিউল শহর এখন অনেক বেশি নারীবান্ধব।
নানা হয়রানির ভয়ে ঢাকার অনেক মেয়েই পড়াশোনা শেষ করেও চাকরি করতে চায় না। নিরাপদ শহর নিশ্চিত করা গেলে তারাও কাজে আসবে, যা অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
তানিয়া হক
সহযোগী অধ্যাপক ও সভাপতি
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : লতিফুল হক