Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বয়স যাদের হারাতে পারেনি

৪ মার্চ ২০১৩, কোরিয়া টাইমস অবলম্বনে মো. মহিবুল্লাহঃ

ফেব্রুয়ারীর শেষটা কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজের পাট চুকানোর সময়। কেউ উচ্চ শিক্ষার পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন আবার কেউবা একেবারে বই-খাতা উঠিয়ে রেখে যোগ দিতে যাচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে। সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণ কিংবা যুবকদের জন্য ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা এই “স্বাভাবিক” সময়টা পেছনে ফেলে এসেছেন অনেককাল আগে, তাঁদের কাউকে যখন এই দলে দেখা যায় তখন ব্যাপারটা কৌতূহল জাগায় বৈকি! বয়স জয় করা এই মানুষগুলোর সাধনা আর অধ্যবসায়ের গল্প অন্যরকম প্রেরণা যোগায়, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে আপনা থেকেই!

chardike-ad

২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩।

দক্ষিণ খিয়ংসাং প্রদেশের হাপচোনে সাংব্যাক এলিমেন্টারি স্কুলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেখা মিলল সত্তরোর্ধ পাঁচ প্রবীণের। নাতিনাতনির বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে তাঁরাও সনদ নিলেন, গলা মিলিয়ে গাইলেন সমাবর্তনের গান। ষাটের দশকের কোরিয়া যুদ্ধের এই প্রত্যক্ষদর্শীরা অর্থাভাবে মাঝপথে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজেরা আবেগপ্রবণ হলেন, দাগ কাটলেন উপস্থিত সবার মনে।

ইনচন প্রদেশে এ বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিলেন মধ্য পঞ্চাশের প্রায় শ’তিনেক শিক্ষার্থী। ন্যাম ইনচন স্কুল কর্তৃপক্ষ ১৫৮ জন মাধ্যমিক পাস ও ১৮২ জন উচ্চমাধ্যমিক পাস প্রবীণের জন্যে আয়োজন করলো সম্মাননা অনুষ্ঠানের, বেশ আড়ম্বরের সাথেই বুড়ো গ্র্যাজুয়েটদের হাতে তুলে দেয়া হল তাঁদের স্বপ্নের সনদ। অনেকেই আবেগটা লুকিয়ে রাখতে পারলেন না; কাঁদলেন, কাঁদালেন।

স্কুলটি ১৯৯৯ সাল থেকে ন্যূনতম বিশ বছর বয়সীদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা দিয়ে আসছে। “ইনচনে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম হবে না যারা কিনা বিভিন্ন কারণে পড়াশুনাটা সময়মত শেষ করতে পারেন নি কিন্তু এখনও সুযোগ পেলে সেটা করতে প্রবলভাবে আগ্রহী। এ ধরণের একটা উদ্যোগে তাই শুরু থেকেই আমরা আশাতীত সাড়া পাচ্ছি, প্রায় প্রতিদিনই নতুন কেউ না কেউ যোগাযোগ করছেন”, বলছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রাধ্যক্ষ ছই উ-সুক।

মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে লিভারে। ডাক্তারের নিষেধ, স্বামী-সন্তানের উদ্বেগ কোনটাই দমিয়ে রাখতে পারে নি ৫৭ বছর বয়সী কিম সা-জুনকে। অসুস্থতা নিয়ে এই বয়সে কেন স্কুলে এলেন এমন প্রশ্নের জবাবে কিম বললেন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পেরুতে না পারাটা তাঁকে সাড়া জীবন পুড়িয়ে এসেছে, সে আক্ষেপটা দূর করার এমন সুযোগ তাই হাতছাড়া করতে চান নি। “খুব গরীব ঘরে জন্মেছিলাম, কোনরকমে প্রাইমারির পাটটা শেষ করতে পেরেছিলাম। বড় ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ আর সংসারের হাল ধরতে কাজে নামতে হল! নিজের লেখাপড়াটা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ আর হল না”, বলছিলেন কিম। সর্বোচ্চ গ্রেডধারীদের একজন হয়েই উচ্চ মাধ্যমিকের সনদ নিলেন সুন-জা। এ পর্যন্ত আসতে পারার জন্যে স্বামী আর মেয়ের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আর সহযোগিতার কথাও স্বীকার করলেন কৃতজ্ঞচিত্তে। মার্চেই ভর্তি হতে যাচ্ছেন জাতীয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়বেন কোরিয়ান ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে।

তিন সন্তানের সংসার সামলে নতুন করে পড়াশুনায় ফিরে আসার কথা একটা সময় পর্যন্ত চিন্তাও করতে পারেন নি ৫৭ বছরের আরেক মা কিম সাং-মি। কিন্তু যখনই মনে হতো বাকি জীবনটা চার দেয়ালে বন্দী থেকেই কাটিয়ে দিতে হবে, তখন দুঃখ আর হতাশার অন্ত থাকতো না। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন আবার পড়াশুনা শুরু করার। ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক কোর্সে ভর্তির জন্য আবেদন করলেন। “কিন্তু কাজটা খুব সহজ ছিল না। প্রথম দিকে মনে হতো এসব আসলে এখন আর আমার জন্যে না! কোনভাবেই তাল রাখতে পারছিলাম না, প্রায়ই ভাবতাম ছেড়ে দেই”, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টার স্মৃতিচারণ করছিলেন কিম, “রাতের পর রাত পড়েছি। কিন্তু যতটুকু সময় দিতাম তততুকু ফল পেতাম বলে মনে হতো না! মাঝে মাঝে সব বেকার, অর্থহীন লাগতো।” কিন্তু এতকিছুর পরেও হাল ছেড়ে না দেবার পিছনে ছিল স্বামী আর সন্তানদের আন্তরিক সহযোগিতা, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতারও তাই শেষ নেই কিমের। এখন আর কোন কিছুই অসম্ভব মনে হয় না তাঁর কাছে, সামনের বছরই ভর্তি হবেন স্নাতকোত্তর কোর্সে। “মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, পরিশ্রমের ফল পাওয়া যাবেই” কিমের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস। “বন্ধুরা অনেকেই বলে আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কিন্তু আমি কখনই মনে করি না বয়সটা এমন কিছু বেশী হয়ে গেছে! জীবনটা আমার, আমি সেটা নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছি!” তৃপ্তিটা স্পষ্ট কিমের গলায়।