Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কোরিয়ার শান্তির প্রতীক কিম দে-জুং


কোরিয়ার ইতিহাসে সেরা রাষ্ট্রপতিদের একজন কিম দে জুং। তিনিই প্রথম কোরিয়ান হিসেবে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। কোরিয়ার স্মরণীয় হয়ে থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলা টেলিগ্রাফের এবারের আয়োজন কিম দে জুংকে নিয়ে লিখেছেন মো মহিবুল্লাহ।

দক্ষিণ কোরিয়ার পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি কিম দে-জুং মূলত স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন দেশটিতে স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর শক্ত অবস্থান ও আজীবন সংগ্রামের জন্য। স্বৈরাচারী সরকারের শত বাঁধাকে উপেক্ষা করে তিনি কোরিয়ায় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার আগে তিনি তিন দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে ব্যর্থ হন। কখনও কারারুদ্ধ, কখনও অপহৃত হয়ে সহ্য করেন সীমাহীন নির্যাতন।চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় নিমজ্জিত অবস্থায় কিম কোরিয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এবং ধ্বংসের প্রায় শেষ সীমা থেকে দেশটিকে ঘুরে দাঁড় করাতে সমর্থ হন। কোরিয়ার পুনঃগঠন ও পুনঃসংস্কারের লক্ষ্যে কিম কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আজ অবধি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রথম কোরিয়ান হিসেবে কিম ২০০০ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

chardike-ad
উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাথে কিম দে জুং
উত্তর কোরিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সাথে কিম দে জুং

কিম দে-জুং ১৯২৫ সালের ৩ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ জিওলার একটি ছোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কোরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সিংম্যান রি’র শাসনামলে। দু’বার ব্যর্থ হবার পর তৃতীয়বারের চেষ্টায় ১৯৬১ সালে কিম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। তবে এবারেও দুর্ভাগ্য তাঁর। পার্ক হুং-হির নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানে সে সংসদও ভেঙে যায়। পার্ক পরবর্তীতে নিজেকে একজন স্বৈর শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

কিমের রাজনৈতিক জীবন তাৎপর্যপূর্ণ মোড় নেয় ১৯৬৩ ও ‘৬৭ সালে পরপর দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে। তিনি বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মুখপাত্র মনোনীত হন। এরপরের বছরই তিনি দলটির নীতি নির্ধারক কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালে কিম পার্কের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সে নির্বাচনে তিনি হেরে গেলেও বেশ ভালো লড়াই করতে সক্ষম হন। তাঁর নিজ দল ও এলাকার মানুষের কাছ থেকে তিনি প্রত্যাশাতীত সমর্থন লাভ করেন। সে নির্বাচনে জিওলা থেকে কিম রেকর্ড পরিমাণ ভোট পান যা কোরিয়ার ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত অনতিক্রম্য রয়ে গেছে।

ক্ষমতায় আরোহণের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পার্ক দেশে মার্শাল ল’ জারি করে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি সংসদ পুনর্গঠনের নামে ইচ্ছেমত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ শুরু করলে কিম তাঁর দলীয় সদস্যদের নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানেও পার্কের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। এরই জের ধরে ১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে টোকিওর একটি হোটেল থেকে কোরিয়া সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর সদস্যরা তাঁকে অপহরণ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের হস্তক্ষেপে এক সপ্তাহের মাথায় তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলেও গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

একটি গনতান্ত্রিক আন্দোলনে প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে ১৯৭৬ সালের পয়লা মার্চ তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে ১৯৭৮ সালেই তিনি মুক্তি পান। এবারও তাঁকে মুক্তির পর গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

১৯৭৯ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট পার্ক তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হওয়ার পর কিম তাঁর নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পান। কয়েকমাস বাদেই সৈনিকদের আরেকটি দল ক্ষমতা দখল করে এবং কিম আবারও কারাবন্দী হন বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে। একটি সামরিক আদালত তাঁকে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। পরবর্তীতে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও শেষ পর্যন্ত ২০ বছরের জেল দেয়া হয়। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে যাওয়ার শর্তে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ম্যাসাচুটেসের বোস্টনে বসবাস শুরু করেন এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেন্দ্রে অতিথি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

১৯৮৫ সালে সিউল ফিরে আসলে তিনি আবারও গৃহবন্দী হন। তবে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করে। ১৯৮৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়া হয় বং তাঁর সকল রাজনৈতিক ও নৈতিক সুযোগসুবিধা সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

১৯৮৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কিম দে-জুং রো তায়ে-উয়োর কাছে পরাজিত হন। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে তিনি তৃতীয় দফায় হারেন কিম ইয়ং-সামের কাছে। একের পর এক পরাজয় তাঁকে খুব হতাশ করে তোলে এবং তিনি ব্যর্থমনোরথে রাজনীতি থেকে সাময়িক অবসর নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি স্কলার হিসেবে যোগ দান করেন।

১৯৯৫ সালে কিম দেশে ফিরে এসে পুনরায় রাজনীতি শুরু করেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন। এশিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার আঘাতে সেসময় দক্ষিণ কোরিয়াও জর্জরিত। ফলস্বরূপ নির্বাচনের মাত্র দু’সপ্তাহ আগে ইয়ং-সাম সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়। এটাই কিমের জন্য ইতিবাচক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইয়ংয়ের উত্তরসূরি লী হই-চ্যাংকে পরাজিত করে কিম দে-জুং দক্ষিণ কোরিয়ার পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

১৯৯৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী কিম যখন আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দা তখন চরমে। কিম খুব দ্রুততার সাথে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর প্রস্তাবনা অনুসারে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন এবং মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি সবধরনের হিসাবরক্ষণ কাজে স্বচ্ছতা নিয়ে আসেন এবং পথে বসতে যাওয়া বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে পুনরায় দাঁড় করাতে সক্ষম হন। যেটা অনেকের কাছেই রীতিমতো অসম্ভব মনে হচ্ছিল সেটাই কিম করলেন অসাধারণ দক্ষতায়। দক্ষিণ কোরিয়া সাক্ষী হয় এক অভূতপূর্ব পুনরুত্থানের।

উত্তর কোরিয়ার সাথে সফল আলোচনার মাধ্যমে কিম দুই কোরিয়াকে যুক্ত করার এক অসাধারণ উদ্যোগ হাতে নেন। এ ব্যাপারে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহকে দুই কোরিয়ার জন্য ‘আলোর ঝলকানি’ হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের উৎপাদন অব্যাহত রেখে এবং সীমান্ত থেকে সেনা না সরিয়ে উত্তর কোরিয়া শর্ত ভঙ্গ করে। ফলে কিমের প্রশংসনীয় উদ্যোগটি শেষ পর্যন্ত আর আলোর মুখ দেখে নি।

তবে উত্তর কোরিয়া সফরের জন্য কিম ২০০০ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে কিম দে-জুং ২০০৩ সালে তাঁর উত্তরসূরি রো মু-হুনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

৩০ জুন, ২০১৩।