Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

যেভাবে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

 

trump-v-hill_17634-1দিন গোনা শেষ। আজই বিশ্বের ক্ষমতাধর পদের নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্যবারের তুলনায় এবার উত্তাপ ছড়িয়েছে একটু বেশিই। এমনকি প্রচারণা চলাকালেই অনেক নিশ্চিত পরিস্থিতি মোড় নিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। তবে জনমত জরিপে বরাবরই এগিয়ে থেকেছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। যদিও শেষদিকে এসে জনপ্রিয়তার পাল্লা ভারী করেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। শেষ পর্যন্ত কে হতে যাচ্ছে পরবর্তী চার বছরের জন্য বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট- প্রথম নারী হিসেবে হিলারি ক্লিনটন, নাকি রিয়েল এস্টেট মোগল ডোনাল্ড ট্রাম্প, সে রায় আজ দেবেন মার্কিনরা।

chardike-ad

মার্কিন নির্বাচন পদ্ধতি কিছুটা জটিল। কারণ অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো কোনো একক ও সমন্বিত সংস্থার অধীনে এদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়ার দেখভাল করে পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য ও স্বতন্ত্র টেরিটোরি এবং দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি। বিষয়টি জটিল আরো এ কারণে যে, এ ব্যাপারে প্রত্যেক রাজ্যেরেই আছে আলাদা নিয়মকানুন। ভোটার তালিকা করা থেকে শুরু করে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত নির্বাচন, ভোট গ্রহণ, ভোট গণনা, ফলাফল সার্টিফাই করা ও ঘোষণা দেয়া ইত্যাদি যাবতীয় কাজ তারাই করে থাকে স্বতন্ত্র নিয়মের অধীনে। শুধু নির্বাচনই নয়, প্রার্থী বাছাই ও মনোনয়ন প্রক্রিয়ায়ও রাজ্যগুলো পৃথক পৃথক নিয়মে ভিন্নভাবে তাদের ভূমিকা পালন করে থাকে।

এবার একটু বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক। সাধারণত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ১০ মাস আগে থেকে পদটিতে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ প্রক্রিয়াও বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। প্রক্রিয়াটি শুরু হয় আইওয়া পার্টি ককাসের মধ্য দিয়ে এবং শেষ হয় নির্বাচনের প্রায় দু’মাস আগে দলের কনভেনশনে, চূড়ান্ত মনোনয়নের মাধ্যমে। প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব থাকে সংশ্লিষ্ট দলের ডেলিগেটদের ওপর।

প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে ঠিক কতজন করে ডেলিগেট, তা ঠিক হয় দু’ভাবে- ককাসে ভোট অথবা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। কোনো রাজ্যে সাধারণ ভোটাররা ভোটের মাধ্যমে ঠিক করেন কে কতজন ডেলিগেটের আস্থা পেলেন। এখানে একটা মজার ব্যাপারও ঘটে। এসময় কখনো এক দলের ভোটার অন্য দলের দুর্বল প্রার্থীকে ভোট দেয়, যাতে তিনি মনোনয়ন পেলে তার দলের, তার প্রিয় প্রার্থী আসল নির্বাচনে সহজে জিততে পারেন। এটাকে বলে মানকি বিজনেস। বাছাই পর্ব শেষ হলে ডেলিগেটরা পার্টির জাতীয় কনভেনশনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করেন।

ককাস ও প্রাইমারি
দলীয় টিকিট পেতে যে দীর্ঘ প্রাথমিক বাছাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় এটিই ‘প্রাইমারি’ ও ‘ককাস’ নামে পরিচিত। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান সমর্থকেরা নির্ধারণ করেন তাদের দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন।

প্রাইমারি হচ্ছে প্রথাগত নির্বাচন, যেখানে দিনব্যাপী গোপন ব্যালটে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রাইমারিতে বিজয়ী প্রার্থী নিজ দলের ওই রাজ্যের প্রতিনিধিদের জাতীয় সম্মেলনে তার পক্ষে ভোট দিতে নিয়ে যান।

অন্যদিকে ককাস হচ্ছে দলের নিবন্ধিত ভোটার ও কর্মীদের সভা, যা পূর্বনির্ধারিত দিন ও ক্ষণে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। পরে তারা ভোটের আয়োজন করে একজন প্রার্থী নির্বাচন করেন। কাউন্টি পর্যায়ের সম্মেলনে ওই প্রার্থীকে সমর্থন দিতে প্রতিনিধিও নির্বাচন করা হয়। কাউন্টি সম্মেলনে অঙ্গরাজ্যের সম্মেলনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। আর অঙ্গরাজ্যের সম্মেলনে নির্বাচিত হন জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধি।

বাছাইপ্রক্রিয়া
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলের পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে। গ্রীষ্মকালের শেষ ভাগে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে রাজ্যগুলোতে ভোটের মাধ্যমে দলীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত করে জাতীয় সম্মেলনে পাঠানো হয়। দলীয় প্রতিনিধিরা সেখানে ভোট দিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন করেন। অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা শুধু প্রাইমারি বা দলীয় ককাসে তাদের মতামত সরাসরি দিতে পারেন।

যেহেতু প্রতি লিপইয়ারে নির্বাচন হয়, তাই প্রেসিডেন্টের শাসনকালের মেয়াদ মাত্র চার বছরের এবং তিনি পরপর দুই টার্মের বেশি প্রার্থী হতে পারেন না। এ নির্বাচনে জাতীয়ভাবে এবং দুনিয়াব্যাপী যদিও আলোচনায় থাকেন শুধু প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা, তথাপি একই দিনে মার্কিন ভোটাররা আরো অনেক পদে প্রার্থী নির্বাচন করে থাকেন- যেমন: কংগ্রেস প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য এবং একাধিক মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেটর, স্টেট লেজিসলেটর, স্টেট সিনেটর, স্টেট গভর্নর ইত্যাদি।

এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে এবং কাউন্টিতে নানা কিসিমের রাজনৈতিক, সামাজিক, আইনি ও রাজস্ব বিষয়ক বিতর্কিত ইস্যুর ওপর গণভোট নেয়া হয়। এবার ওয়াশিংটন ডিস্ট্রিক অব কলাম্বিয়াকে (ওয়াশিংটন ডিসি) অঙ্গরাজ্য ঘোষণার দাবিতে গণভোট হবে।

এখানে একটা কথা জানা দরকার- মার্কিন কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের মেয়াদ মাত্র দুই বছরের। তাই তারা প্রতি দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাঝখানে আরেকবার জনগণের ম্যান্ডেট নিতে বাধ্য। ওই নির্বাচনকে বলে মিডটার্ম ইলেকশন। ফেডারেল সিনেটরদের মেয়াদ ছয় বছরের, তবে তাদের মেয়াদ পালাক্রমে এমনভাবে বিন্যাস করা যে, প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর কিছু না কিছু সিনেটরকে ছয় বছর পূর্ণ করে নির্বাচনের মাঠে নামতে হয়, স্টেট গভর্নরদের মেয়াদ চার বছরের এবং তাদেরও কাউকে না কাউকে মিডটার্ম ইলেকশন মোকাবেলা করতে হয়।

নির্বাচনের ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে উভয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী তার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর রানিংমেটের নাম ঘোষণা করেন। প্রেসিডেন্ট পদে যে জেতেন তার রানিংমেট আপনা আপনিই জয়যুক্ত বলে বিবেচিত হন। এবার হিলারি ক্লিনটন তার রানিং মেট হিসেবে বেছে নিয়েছেন টিম কেইনকে আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের রানিং মেট মাইক পেন্স।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নভেম্বরের প্রথম দিকে (৮ নভেম্বর, মঙ্গলবার), কিন্তু শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে বসতে বসতে হয়ে যায় জানুয়ারির শেষ (২০ তারিখ)। তিনি এই আড়াই মাস সময় পান সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে তার গোটা প্রশাসনিক টিম সাজানোর জন্য। এ অন্তর্বর্তী সময়ে বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে বলা হয় “লেম ডাক প্রেসিডেন্ট”। তিনি শুধু দৈনন্দিন রুটিন কাজ চালিয়ে যান, যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাকে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের (President Elect) এর পরামর্শ নিতে হয়। নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথেই ফেডারেল সিক্রেট সার্ভিসের নিরাপত্তারক্ষীরা President Elect-এর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন।

প্রার্থীরা ব্যক্তিগত ও পার্টির উদ্যোগে দেশের ভেতরে ফেডারেল আইনানুযায়ী যে চাঁদা আদায় করেন, তা দিয়েই নির্বাচনী ব্যয় সঙ্কুলান করেন। সে দেশে নির্বাচন প্রচারণার সময় বাংলাদেশের মতো মাঠে ময়দানে জনসভা হয় না। মিটিং যা হয়, তার সবই ঘরোয়া।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে অথবা টাউন হলে গণজমায়েত- বক্তৃতা, বিবৃতি, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি। বাকি সব প্রচারণা চলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। ক্যাম্পেইনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক হলো নির্বাচনের তিন-চার সপ্তাহ আগে প্রার্থীদের মুখোমুখি জাতীয়ভাবে টেলিভাইজড ডিবেট। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে হয় পরপর তিনটি ডিবেট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মাঝে হয় একটি। এসব ডিবেট ও তাদের ফলাফলকে ঘিরে ভোটারদের মধ্যে দেখা যায় দারুণ উত্তাপ ও উত্তেজনা। শেষ মুহূর্তে আনডিসাইডেড ভোটারদের সিদ্ধান্তে এসব ডিবেট বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

মূল নির্বাচনের আগে আগাম ভোটের ব্যবস্থা আছে, তবে এতেও একেক রাজ্যে একেক নিয়ম মানা হয়। নির্বাচনের আগে এবং ওইদিন ভোটাররা ভোট দেন, কিন্তু প্রার্থীরা সরাসরি সে ভোট পান না। ভোট পড়ে তাদেরই মনোনীত ইলেকটোরাল কলেজের সপক্ষে। পরবর্তী পর্যায়ে এই ইলেকটোরাল কলেজের দ্বারা আলাদা আলাদাভাবে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসি মিলিয়ে মোট ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যা ৫৩৮। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যের ইলেটর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এই ৫৩৮ মূলত মোট ৪৩৫ জন জাতীয় প্রতিনিধি, তিন জন ইলেকটর এবং ১০০ জন সিনেটর এর যোগফল। একজন প্রার্থীতকে জিততে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাইতে হয়। অর্থাৎ জিততে লাগে মোট ইলেকটরের অর্ধেকের সাথে এক বেশি।