Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সফরসঙ্গী

tausif
বিতর্কিত ডকডো দ্বীপে কোরীয় পতাকা হাতে লেখক

দেশের বাইরে প্রথম আসা। উদ্দেশ্য পড়াশোনা করা। উৎসাহ সীমাহীন। নতুন দেশ দেখব। কত কী না হবে। প্রথম কয়েক দিনেই এই উৎসাহে চরম ভাটা পড়ল। কিছুতেই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। দেশটার নাম দক্ষিণ কোরিয়া। বাংলাদেশিদের প্রধান আতঙ্ক কোরীয় খাবার। আমার বেলায় প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াল উপযুক্ত বন্ধু খুঁজে পাওয়া। নিজের দেশের মানুষদেরও ভিনদেশি মনে হতে লাগল।

পাক্কা ছয় মাস পর ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করল। ঠিক করলাম চিরচেনা নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলার। নানা দেশি মানুষের সঙ্গে মিশব। একাকিত্ব বলতে কিছু রাখব না। প্রথমেই দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে স্প্যানিশ নাচের ক্লাসে যোগ দিয়ে দিলাম। এই ধরনের নাচে সঙ্গিনী প্রয়োজন। আমার সহযোগী হলেন এক রাশিয়ান কলিগ। জীবনে এই প্রথম নাচ শেখা। তাই চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলাম না। টানা ছয় মাস পর আমি নাচে ইস্তফা দিয়ে দিলাম। সেই ভিনদেশি সংস্কৃতি আমার ধাতে সইল না। একে তো নাচ জিনিসটাই খুব কঠিন, তারপর আবার বিপরীত বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে জুড়ি।

chardike-ad

এদিকে স্কলারশিপের শর্ত মোতাবেক কোরীয় ভাষার পরীক্ষাতে অবতীর্ণ হতে হলো এবং নিজেকে অবাক করে দিয়ে পাস করে ফেললাম। ভাবলাম এবার আর কোনো বাধা নেই। দে ছুট অসীমের পানে। ছোট কোনো কিছু করাতে গর্ব নেই। তাই একাই তিন দিনের এক ট্যুরে চলে গেলাম। মোট ৮৮ জন পর্যটক বিভিন্ন দেশের—আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও কোরীয়।

প্রথমেই সমস্যা শুরু হলো রুমমেট নিয়ে। আমি একা হওয়াতে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করল। শেষ পর্যন্ত এক অদ্ভুত দলের সঙ্গী হয়ে গেলাম। প্রতি রুমে চারজন। আমার সঙ্গে বাকি তিনজন তিন দেশের নাগরিক—অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও আয়ারল্যান্ড। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কানাডা ও আয়ারল্যান্ডের দুজনই মেয়ে। বাঙালি সংস্কৃতিতে যেটা অস্বাভাবিক ব্যাপার।

প্রথমেই রুমে ঢুকে বললাম, আমি নামাজ আদায় করব। আশা করি তোমাদের এতে কোনো আপত্তি নেই। তাঁরা একবাক্যে সম্মতি জানালেও নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা অনুচ্চ স্বরে আমাকে রুমমেট হিসেবে মেনে নিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করল। সেটাই প্রথম ও শেষ নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল তাদের সঙ্গে আমার। এরপরের তিনটা দিন যে কীভাবে গেল টেরও পেলাম না। ট্যুর শেষে তাঁরা বারবার দুঃখ প্রকাশ করছিল আমাকে সঠিকভাবে সঙ্গ না দেওয়ার জন্য। আর আমি বারবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছিলাম যথার্থ আচার-আচরণের জন্য।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে মোটামুটি দুঃসাহসী করে তুলল। তাই পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে প্যারাগ্লাইডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। আরেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা—ইংল্যান্ডের এক ভদ্রলোকের এশিয়ার অর্থনীতির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, ভারতীয়দের সঙ্গে হাল আমলের হিন্দি সিনেমার আলাপ, কোরীয়-আমেরিকান জুটির হাস্যকর প্রেমালাপ। সব বলতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে।

এ রকম অভিযান অব্যাহত ছিল। অব্যাহত ছিল নানা দেশের মানুষের সঙ্গে সময় কাটানোর অমূল্য সব মুহূর্ত। তারাপর কোরীয় সীমান্তের দিমজির (DMZ=Demilitarized Zone) উদ্দেশে যাত্রা। সুদর্শন গাইডের নিখুঁত ইংরেজি ও কোরীয় শুনে বোঝার উপায় নেই যে তিনি একজন ইরাকি। কুর্দিস্তানি হিসেবেই তিনি নিজেকে পরিচয় দেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যে আত্মবিশ্বাস আমরা বাঙালিরা দেখাতে কুণ্ঠাবোধ করি তা একটি মুক্তির প্রক্রিয়াধীন দেশের মানুষ সগর্বে করে দেখালেন।

আমেরিকান মিলিটারি সদস্যদের সঙ্গে একবার শামিল হয়েছিলাম। সেখানে একজন সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করলেন! বাহরাইনে মার্কিন মিলিটারি ঘাঁটিতে কাজ করার সুবাদে তিনি নাকি বহু বাঙালিদের চেনেন। রুমমেট হিসেবে ১১ জন ভারতীয়র আতিথেয়তা কিংবা পাকিস্তানি বন্ধুদের সঙ্গে সউলের শিয়া মসজিদে রাত কাটানো, বিতর্কিত ডকডো দ্বীপে গ্যাংনাম স্টাইল গানের মাধ্যমে কোরীয় জাতীয়তাবাদের প্রদর্শনী—কোনটাকেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। সবচে অদ্ভুত ছিল এক সৌদির মুখে কেমন আছেন শোনা। বিদেশে পড়াশোনা করতে এসে নিজেকে চিনলাম, চিনলাম বিশ্বকে।

লিখেছেন: তাওসীফ রহমান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে
সৌজন্যে: প্রথম আলো