Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আমেরিকান ড্রিম বনাম বাস্তবতা

americaবেঁচে থাকতে নাজমার ইচ্ছা ছিল তার জামাই হবে একজন ডাক্তার। সেটা পূরণ করেছিল শেফালী। জীবনের পথে চলতে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিল ডাক্তার ফজলেকে। বিভিন্ন গুণের সংমিশ্রণে গড়া ডাক্তার সাহেব। নিপুণ রাঁধুনী আবার সরস রসিকও। শ্বশুর বাড়ি এলে বেমালুম ভুলে যায় যে সে জামাই। মনের ভিতর ঘুরপাক খায় একটা কথা : আচ্ছা আমার শ্বশুর তিনিও তো একদিন জামাই ছিলেন। তাহলে অবস্থানটা অদল বদল করলে কেমন হয়। আর কোনো কথা আছে। লেগে পড়ে রোস্ট, হালিম, তেহরি, চপ, চিকেন বিরিয়ানির দিকে। আরও কত কিছু সব উঁচু মানের রান্না। বেচারা শ্বশুর আবার নতুন করে জামাই হয়ে পড়ে।

শ্বশুর রুহুল আলমের কয়েকটা আদরের বিড়াল। বাইরে থেকে পাওয়া আর থাকেও বাইরে বাড়ির চত্বরের ভিতর। কি বরফ, কি বৃষ্টি, কি ঝড়, ওদের প্রয়োজনে সব সময় রুহুল আলম। হঠাৎ করে রুহুল আলমের স্ট্রোক। যা হোক সুস্থ হয়ে ফিরে এলে আলোচনা হচ্ছিল কি ভাবে ভালো হল। নানা মত। চট করে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারা, ডাক্তারের সঠিক চিকিৎসা, ঠিকমতো সেবা যত্ন। ডাক্তার ফজলের একটাই মত : বিড়ালের দোয়া।

chardike-ad

নকশা করে বানানো বিরাট একটি বাড়ি সুমির। সবার আগে এঁকেছিল বাপ-মায়ের থাকার আর নামাজ পড়ার ঘর। নিজের বাড়ি শুরু করার আগে বাপ-মায়ের বন্ধকি বাড়িটিকে ঋণমুক্ত করেছিল। কিনবার সময় সিংহভাগ পয়সা ওরই দেয়া। এখন মায়ের হাতের লাগানো গাছগুলোর সঙ্গে প্রায়ই কথা বলে; মাঝে মধ্যে ভেসে আসে মায়ের সেই প্রিয় ডাকটা।

ছেলেমেয়ে সবারই ভালো চাকরি। ঝলমলে জীবন। নাজমা আর রুহুল আলমের সংসারে এখন আনন্দের জোয়ার। হঠাৎ করে নেমে এলো বিষাদের ঘন ছায়া। নাজমার ক্যান্সার। আর সেটা শেষ পর্যায়ে। অল্প দিনের যাত্রী। ইতিমধ্যে যুদ্ধ শুরু ইরাকে। একমাত্র ছেলে ইমনকে ডেকে নিয়েছে বাগদাদে। সেখান থেকে কি আর সে ফিরবে। আর ফিরলেও ততদিন কি নাজমা বেঁচে থাকবে। রেডক্রসের মাধ্যমে চেষ্টা করে দুই-এক দিন ছুটি নিয়ে মাকে দেখে আসা তো দূরের ব্যাপার, মায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগও পাওয়া গেল না। মুষড়ে পড়ল নাজমা। তখন তার আমেরিকান বন্ধুরা প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান কার্ট ওয়েলডেনের কাছে জোরালো আর্জি পেশ করল। এক সপ্তাহের ভিতরেই সশরীরে ইমন এসে হাজির। শুধু তাই নয়। পোস্টিংটা বাগদাদ থেকে নিউজার্সিতে, সাময়িক ভাবে নয় পাকাপোক্ত যাতে মার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে।

শেষের যে কয়েকমাস নাজমা নিজের পায়ের ওপর ভর করে হেঁটে বেড়াতে পারত সেই দিনগুলোকে ভরিয়ে দিয়েছিল সুমি মায়ের একান্ত বান্ধবী হয়ে। শপিংমলে, রেস্টুরেন্টে, আড্ডাতে, পাড়াবেড়াতে, কখন যে দিনের আলো নিভে যেত তার কোনো খোঁজই থাকত না। নাজমার শূন্যতাকে সামলিয়ে নিতে পারেনি ছোট মেয়ে শেফালী, সেদিন মা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল সুমি। এতদিনের শক্ত বাঁধনটা বিলীন হয়ে যাওয়াতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল রুহুল আলম। তবে সেটা ক্ষণিকের জন্য। নতুন রূপে পেল বড় মেয়ে সুমিকে।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গেলেও হিসেবের জ্ঞানটা টনটনে রুহুল আলমের। আপনার সংসারটা কত বড় এই প্রশ্ন করলে মাথাটা একটু ঘুরিয়ে আর একগাল রহস্যময়ী হাসি ছড়িয়ে বলেন, তেমন কিছু বড় নয়, চার ছেলে আর চার মেয়ে। অবশ্য একটু পরেই আবার একগাল প্রাণভরা হাসি দিয়ে বলেন, আমার আর নাজমার বিয়ের ফসল কিন্তু তিন মেয়ে আর এক ছেলে। তা হলে হিসাবটা কি করে মেলে? আরে জানেন আমার তিন মেয়ের জন্য তিন জামাই কিন্তু আসেনি। এসেছে তিন তিনটি প্রাণবন্ত নিজেরই ছেলে। আর সনাতন বৌমায়ের দেখাও তো পাইনি। পেয়েছি একটি মায়া ভরা মেয়ে।

রুহুল আলমের অভ্যেস আছে একটু আধটু হাঁটার। মাঝে মধ্যে নাতিকে কাঁধে নেন। কচি হাত জড়িয়ে ধরে থাকে গোটা মাথাটাকে। অপূর্ব শিহরণ জাগে। হাঁটতে হাঁটতে কখন এক সময় ফিরে আসেন অনেক পেছনের সেই দুর্দিনের দিনগুলোতে। তবে সেটা মুহূর্তের জন্য; নিমিষের মধেই ভিড় করে দাঁড়ায় সাফল্যে ভরা আজকের ঝলমলে দিনগুলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখেন; হঠাৎ একটা ঝটকা আসে। ভাবেন এসব কি স্বপ্ন? স্বপ্ন ঠিকই। তবে তা আমেরিকান ড্রিম। সাধারণ স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আর আমেরিকান ড্রিম? শ্রম আর সাধনার সমাবেশ দেখলে মাঝে মধ্যে স্বপ্ন জগতটাকে ডিঙিয়ে নেমে আসে বাস্তবে।

লেখক: মোনায়েম চৌধুরী (গল্পকার ও অধ্যাপক, চেনি বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা)