Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি (পর্ব-১)

highier-education-in-foreignজাপান সরকারের স্কলারশিপ ‘মনবুশো’ নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে জাপানে এসেছি প্রায় তিন বছর আগে। এই সময়টাতে প্রায় প্রতিদিন আমার কাছে ইমেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নানা জিজ্ঞাসা এসেছে।

অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, উচ্চশিক্ষায় কীভাবে স্কলারশিপ পাওয়া যায়, কীভাবে অধ্যাপক ম্যানেজ করা যায়? কী ধরনের যোগ্যতা লাগবে? জাপানের পড়াশোনার পরিবেশ কেমন? নিজেদের প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হবে?

chardike-ad

প্রশ্নগুলো সাধারণত একইরকম হলেও প্রতিদিনই আমার কাছে আসছে। তাই আমি তিন পর্বে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

সর্বশেষ পর্বটি সাজাবো আপনাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রশ্নের উত্তরে। তাই পাঠকদের অনুরোধ করবো, এই লেখাগুলো পড়ার পরও যদি কারও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে আমাকে nadim.ru@gmail.com ইমেইল করার জন্য অনুরোধ রইলো।

আপনার লক্ষ্য কী?: আপনি যখন এই লেখাটি পড়ছেন, ঠিক তখন নিজের কাছে একটা প্রশ্ন করুন তো, আপনার ভবিষৎ স্বপ্ন কী? আপনি ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? আমাদের জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে নিয়ে যে কাউকে প্রশ্ন করলেই উত্তর দিতে দ্বিধায় পড়ে যান। স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেও যখন কাউকে এ প্রশ্ন করা হয়, আর তার ‘ভবিষ্যৎ’ জীবনের কোনো দৃশ্য ধরা পড়ে না, তখন বুঝতে হবে- এটা আমাদের একার সমস্যা নয়, এটা আমাদের জাতির মজ্জাগত সমস্যা।

স্কুল কিংবা কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করলেই তার মুখ থেকে বের হবে, সে বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। তবে বর্তমান সময়ে প্রশ্ন করলে খুব বেশি যে উত্তরটি পাবেন, তাহলো বিসিএস ক্যাডার কিংবা সরকারি চাকুরে হব। এই দেশের শিশু-কিশোরদের কারও মুখ থেকে শুনবেন না, তারা বড় হয়ে গবেষক কিংবা ভাল শিক্ষক হবেন, কিংবা কৃষক হবেন।

আমরা অল্প সময়ে বেশি অর্জন করতেই বেশি বিশ্বাসী হয়ে উঠছি। তাই আমাদের পরিবারের সদস্যরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন দেখায়। দিনশেষে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে মুখ কালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই বাধ্য হই।

আপনি কি বলতে পারবেন, প্রতি বছর দেশে যে কয়েক হাজার ডাক্তার বের হচ্ছেন, তাদের মধ্যে কতোজন ভালো ডাক্তার হতে পারছেন? কতজন এই পেশায় সফল হচ্ছেন? কিংবা প্রচলিত অর্থে বাংলাদেশে প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে কতোটা প্রয়োগিক প্রকৌশলী গড়ে উঠছে?

আপনি একটা বিভাগীয় শহরে যাবেন, সেখানে হাতে গোণা কয়েকজন চিকিৎসক নামডাক ঘরে তুলছেন। আর বাকিরা গতানুগতিক পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাদেরকে ছোট করছি না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, আমাদের মেধাবীদের মেধা বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, তারা অবশ্যই মেধাবী। তবে আমরা তাদের মূল্যায়নের পথগুলো বন্ধ করছি। কেবল আর্থ-সামাজিক অবস্থার ছুঁতো তুলে। সম্ভবত জীবনের লক্ষ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ না করার কারণে বাংলাদেশ অনেক মেধাবীদের মেধাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

কেনো গবেষক হবেন?: আজ আমরা আমাদের চারপাশের অসংখ্য জিনিসপত্র ব্যবহার করছি, খাচ্ছি, চলছি। এর মূলে রয়েছে বিজ্ঞানীদের অগাধ পরিশ্রম। এগুলো একদিনে আসেনি। এটার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে আমরা আজ বিজ্ঞানের সুবিধা ভোগ করছি। তাই একজন গবেষক বা বিজ্ঞানীর সৃষ্টিশীল কর্ম অন্যান্য পেশার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণা করা কেবল একটা পেশা নয়, এই পৃথিবীর জন্য, প্রকৃতি ও মানব সভ্যতার কল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া। যদিও সব ধরনের পেশার উদ্দেশ্যে একই ধরনের, তবে এই গবেষণার রয়েছে আলাদা লাবণ্য।

আপনি যদি মনে করেন, আমার সৃষ্টিশীল কর্ম আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগ যুগ ধরে, তাহলে আপনি নিঃসন্দেহে গবেষণাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন। আর যদি মনে করেন, পিএইচডি কেবল মাত্র পদান্নোতির জন্য, তাহলে বলবো, সেটা কেবল নিরর্থক। আপনার গবেষণার ইচ্ছা হোক মানব সভ্যতার উন্নয়নে, নিজের দেশ ও সমাজের উন্নয়নে।

উচ্চশিক্ষা কী?: আমার কাছে আপত্তিকর একটি শব্দ হলো ‘উচ্চশিক্ষা’। আমি এই শব্দটির প্রয়োগের পক্ষপাতি নই। কারণ, শিক্ষার কোন উঁচু-নীচু ধাপ নেই। প্রাথমিক থেকে পিএইচডি যেমন শিক্ষা, তেমনি সারাটি জীবন প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে শিক্ষা নেওয়াটাও শিক্ষা। ‘শিক্ষা’ কেবলই শিক্ষা। এখানে উচ্চ কিংবা নিম্ন শিক্ষা বলা বেমানান। তবে আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা বলতে ‘পোস্ট গ্রাজুয়েট’ পড়াশোনা, যেমন- মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি ইত্যাদিকে বোঝানো হয়।

আমাদের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় আমরাও আপনাদের বোঝাবার জন্য মাঝে মধ্যে উচ্চশিক্ষা শব্দটি প্রয়োগ করেছি। দেশের যেকোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায় শেষে মূলত শুরু হয় ‘উচ্চশিক্ষার সিঁড়ি’।

দেশের বাইরে কেনো আসবেন?: বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের চাকরি-জটে জর্জড়িত আমাদের তরুণদের জীবন। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পর আমাদের চাকরির জন্য যে সময়টুকু ব্যয় হয়, তা আমাদের কর্মক্ষম সময় থেকে দুই-তিন বছর অনায়াসে খেয়ে ফেলে। তাই এই তরুণদের সময়টুকু নিজেদের পেশাদারিত্বের দক্ষতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ হতে পারে অনবদ্য সংস্করণ। সম্ভবত বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ছেলেমেয়েরা এই কৌশলে এগিয়ে চলছে।

আশার কথা হলো, আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় যেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কেবলমাত্র ধনী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে ছিল, সেটা থেকে বের হয়ে আমরা এখন সমাজের যেকোনো পরিবেশে বেড়ে উঠেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে দেশের বাইরে আসতে পারছি।

সেটা সম্ভব হচ্ছে আমাদের মেধার কারণে। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে আসে, তাদের আশি ভাগই পিএইচডি প্রোগামে কিংবা এমএস প্রোগামে আসে। তবে এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদেরই কেবল জয়জয়কার। তবে অন্য ফ্যাকাল্টির ছেলেমেয়েরাও ভালো করছে।

আমাদের মতো ছোট একটি উন্নয়নশীল দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠির খুবই প্রয়োজন। যে বাড়ি থেকে আজ ছেলেটা বা মেয়েটা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে বাইরে পড়াশোনার জন্য আসছে, নিশ্চয়ই এটা এক ধরনের বড় ধরনের পরিবর্তন। এটা শুধু তার পরিবারের নয়, সমাজ, রাষ্ট্রেরও পরিবর্তন। জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন। সভ্য-রুচিশীল মানবিক গুণাবলীর বিকাশেও উচ্চশিক্ষা হতে পারে উন্নয়নের চাকা।

আমাদের দেশ থেকে একটি বড় জনগোষ্ঠী মধ্যপাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকাকে করছে সচল। আমরা শ্রমিক পাঠানোর দেশ নই। আমাদের মেধা আছে, আমরা সেই মেধা দিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র জয় করতে পারি। তাই আমি বিশ্বাস করি, যেসব ছেলেমেয়েরা চাকরির পেছনে বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে, তাদের জন্য উচ্চশিক্ষা জীবন গড়ার সোপান হতে পারে। তাই, নতুন করে লক্ষ্য স্থির করুন। আজ থেকে শুরু করুন উচ্চশিক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি।

উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি: উচ্চশিক্ষার জন্য যদি দেশের বাইরে আসতে চান, তাহলে প্রস্তুতি নিন তৃতীয় বর্ষ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বেরিয়ে পড়ুন বিশ্বকে জানতে। উচ্চশিক্ষার জন্য যে প্রস্তুতি সবার আগে প্রয়োজন, তাহলো আপনার ইংরেজি দক্ষতা। আপনি ইংরেজিতে দক্ষ হোন, দেখবেন পৃথিবীর অনেক কিছুই আপনার জন্য সহজ হয়ে গেছে। তবে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি এই বিষয়টি ধারণ করছে না, তাই আমাদের পিছিয়ে পড়ার জন্য বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য যেসব প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাবেন-

ইংলিশ স্কোর: বিদেশি শিক্ষায় এই জিনিসটি সিজিপি-এর চেয়ে বেশি মূল্যবান। টোফেল, আইইএলটিএস, টোয়েক, জিআরই একজন শিক্ষার্থীর বিদেশি শিক্ষা গ্রহণের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং, যারা বাইরে পড়াশোনা করতে আগ্রহী, তারা সিজিপিএ নির্ভর না হয়ে ইংলিশ স্কোর বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিন। বর্তমানে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি স্কোর নির্ধারণ করে দেয়। সেক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী ‘ইংলিশ প্রোফেসিয়েন্সি টেস্ট’ দেওয়া প্রয়োজন।

আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে চান, তাহলে জিআরই বাধ্যতামূলক। টোফেল আর জিআরই স্কোর যদি আপনার হাতে থাকে, তাহলে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ আপনার কাছে মামুলি ব্যাপার। এই স্কোর থাকলে যেকোনো শিক্ষার্থী তার সিজিপিএ বেশি হোক আর তিনের নিচে হোক, সে স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে পড়াশোনার সুযোগ পাবে।

টোফেলে ৬৫, আইইএলটিএস ৫ দশমিক ৫, টোয়েকে ৫৫০ কে মধ্যম স্কোর ধরা হয়। তবে ভাল স্কোর অবশ্যই ভাল কিছু দেয়। তাই আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে যারা এখনও আছেন, তারা সিজিপিএ-কে মূখ্য না করে ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়িয়ে দিন। দেখবেন কাজে লাগছে।

দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা জাপানের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ প্রোফেসিয়েন্সির স্কোর লাগে না। তবে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, সেখানে টোফেল বা টোয়েক বাধ্যতামূলক। তেমনি টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, কিয়েতো বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইদানিং বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি স্কোর থাকা আবশ্যক।

আমাদের শিক্ষার্থীদের দুর্বল জায়গা হলো ইংরেজি। আপনি যতক্ষণ বিসিএসের এক গাঁদা নোট-গাইড পড়ছেন, তার তিন ভাগের এক ভাগ সময় যদি ইংরেজিতে দেন, তাহলে আপনি অবশ্যই ভাল করবেন। ইটিএস ওয়েব সাইট থেকে টোফেল-টোয়েক সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন।

আমি আমার অগ্রজ-অনুজদের অনুরোধ করবো, স্লো-মোশনের ইংরেজি সিনেমা দেখার জন্য। ইদানিং বেশ কিছু ওয়েব সাইট পডকাস্ট প্রচার করে। আপনি বিবিসি, সিএনএন সংবাদের পাশাপাশি ফক্সনিউজ, এনপিআর, হোমটক ইউএসএ, সায়েন্স ৩৬০ অনলাইন রেডিও ইত্যাদি শুনতে পারেন।

ইংরেজি লিসনিং দক্ষতা বাড়াতে টেডটকে https://www.ted.com গিয়ে লেকচারগুলো শুনতে পারেন। নিজের মানসিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে এই সাইটটি শক্তিশালী অবদান রাখবে।

একাডেমিক ফলাফল: আমাদের দেশে এক সময় একটা ধারণা ছিল, যারা আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে ভাল ফলাফল করে, বিদেশি শিক্ষা কেবল তাদের জন্য। কিংবা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পিএইচডি গ্রহণ কেবল তাদেরই মানায়। অথবা আপনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, নিজেকে এই কাতারে দাঁড় করাতে ভয় পাচ্ছেন?

আপনার সিজিপিএ তিনের নিচে কিন্তু আপনি স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করতেই ভয় পাচ্ছেন? আসুন, এই বদ্ধমূল ধারণাগুলোর পরিবর্তন করিয়ে দেই। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল উচ্চশিক্ষা গ্রহণে প্রতিবন্ধকতা নয়, কখনোই নয়।

আগামী পর্বে বিস্তারিত থাকবে ফলাফল, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করতে থিসিস বা পাবলিকেশন কতোটা প্রয়োজন? স্কলারশিপ পেতে কী লাগবে?

লেখক: এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকে
ইমেইল: nadim.ru@gmail.com
সৌজন্যে: বিডিনিউজ