Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিয়েটাই ভেঙে গেল, সোশ্যাল মিডিয়ায় জন্য…

বিয়েটা ভেঙেই গেল। ঝগড়াঝাঁটি-মারধর নয়। সে সবেরও অবকাশ ছিল না যে। স্বামীর সঙ্গে কখনও দরকারি কথা বলারই সুযোগ মিলত না নিবেদিতার। কাজ নয়, সোশ্যাল মিডিয়া। অবসর মানেই অভীকের চোখ ফোনের পর্দায়। দূরত্ব বাড়তে বাড়তে শেষে বিয়েটা ভাঙার সিদ্ধান্তই নিতে হল নিবেদিতাকে।

chardike-ad

নিবেদিতা একা নন, এ রকম ঘটনা ভূরি ভূরি এখন শহর কলকাতায়। স্বামী-স্ত্রী-একমাত্র সন্তানের সংসার এখন মাঝেমাঝেই নিস্তব্ধতায় খাঁ খাঁ করার প্রসঙ্গ উঠছে সমাজতাত্ত্বিকদের আলোচনায়। শুধু যে দাম্পত্যে চিড় ধরছে, তা নয়। এরই মধ্যে হোয়াট্‌সঅ্যাপের নেশায় পাঁচ বছরের ছেলেকে স্কুল থেকে আনতেই ভুলে গিয়েছেন মা। ছুটির আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রধান শিক্ষিকার ফোনে মায়ের টনক নড়ে। বাড়ি থেকে ছেলের স্কুলে পৌঁছতে লেগেছিল আরও ঘণ্টা খানেক। তত ক্ষণে শিশুটি কেঁদেকেটে একশা।

গৃহবধূ এষার আবার ফেসবুকের আসক্তির জেরে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে শুরু হয়েছে খানিক টানাপড়েন। মায়ের থেকে শেখা রেসিপি ইতিমধ্যেই খাদ্য রসিকদের গ্রুপে বেশ কয়েক বার পোস্ট করে ফেলেছেন তিনি। সে সব লাইকও পেয়েছে শ’খানেক। কিন্তু গোল বেধেছে সেই খবর মায়ের কানে যেতেই। দিদার থেকে সেই সব রান্নার তুকতাক জেনেছিলেন মা। বংশ পরম্পরায় তা এষারও প্রাপ্য। কিন্তু সেই রেসিপি নাকি কোনওমতেই পরিবারের মেয়ে-বৌদের বাইরে কারও হাতে যাওয়ার কথা নয়। এমনটাই হয়ে আসছে বহু প্রজন্ম ধরে। ওই পরিবারের মেয়েদের রান্নার জাদুতেই মোহিত নাকি পরিচিতেরা। সেই রেসিপি বাইরে যাওয়া ‘অমঙ্গলের’। এমনই বিশ্বাস মায়ের। ফলে এখন আর মেয়েকে ভরসা করতে পারছেন না মা।

সমাজ মাধ্যমের এই জটিলতার জেরে এখন রীতিমতো কাউন্সেলিং সেশন শুরু হয়েছে স্কুল-কলেজ-অফিসে। কোন কথা বা ছবি যাবে সমাজ মাধ্যমের গ্রুপে আর কোনটা থাকবে একেবারেই ব্যক্তিগত, সে কথা নতুন করে ভেবে দেখার পাঠ দিচ্ছেন কাউন্সিলরেরা। কারণ এক মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা বলছে, এখন এর জেরেই সবচেয়ে বেশি ভাঙন ধরছে সম্পর্কে। একটি সমীক্ষা রিপোর্টে উঠে এসেছে, শুধু কোন কথাটা কোথায় বলা যায়, সেই বিবেচনা বোধের অভাবে প্রতি দিন বেশ কয়েকটা করে বিয়ে ভাঙে। এ শহরেও এমন ঘটনা কম নয়। যেমন পেশায় নার্স করবীর বন্ধুরা রীতিমতো তাঁকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা বেশ কিছু দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখে চলেছেন তিনি। বন্ধুরা বারবার বারণ করলেও শোনেননি। তাতে আরও বেড়েছে দাম্পত্যের তিক্ততা। এমনই নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছেন দেশ-বিদেশের মনোবিদেরা। অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, একাকিত্ব যত বাড়ছে, ততই বেড়ে চলেছে সমাজ মাধ্যমের আসক্তি। আবার সমাজ মাধ্যমের প্রতি আসক্তিতেই আরও বাড়ছে একাকিত্ব। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র যেমন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘একাকিত্ব তো বাড়ারই কথা। সমাজটা হাতের মুঠোয় ফোনের পর্দায় আছে বলে যদি আমরা ঘর আর বাহিরকে আলাদা না করতে পারি, তবে তো এমন দিন আসবেই। এখন সকলেই নিজের নিজের মতো করে সুখে থাকতে চান। সমাজ মাধ্যমে আড়াল থেকে সেই সুখ দেখতে এবং দেখাতে ভালবাসেন। সম্পর্ক কখনও আড়াল থেকে টিকে থাকে নাকি? ফলে মানুষ আরও একা হচ্ছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ছোটদের যদি এখন থেকেই সমাজ মাধ্যমের কুফলের বিষয়ে একটু সচেতন না করা যায়, তবে সমস্যা আরও গুরুতর হবে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ এ নিয়ে বিভিন্ন স্কুলে ইতিমধ্যেই কর্মশালা করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সব জায়গায় গিয়েই বাবা-মায়েদের বলি, মোবাইলটা শিশুর হাতের নাগালের বাইরে রাখুন। ছেলে-মেয়েদের ভোলানোর জন্য তাদের হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে দেওয়া সবচেয়ে চিন্তার। নিজেরা সেই জায়গায় যদি একটু ভাবনা-চিন্তা করে নানা রকম খেলনার ব্যবস্থা রাখেন, তাতেই মোবাইলের প্রতি টান কিছুটা কম থাকে।’’ কিন্তু সমস্যা হল, অধিকাংশ অভিভাবকই এখন নিজেদের সুবিধের কথা ভেবে মোবাইল ধরিয়ে দিচ্ছেন দেড়-দু’বছরের সন্তানের হাতে।

সুত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা