Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আমরা ভীত নই, ক্ষুব্ধ

ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও উৎপল দাসের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনই দেখা হতো। অফিস শেষে রাতে সাংবাদিকদের ‘ইটিভির গলির’ আড্ডায় প্রিয়মুখ ছিল উৎপল। ‘হতো’ ‘ছিল’- এ শব্দগুলো লিখতে হচ্ছে কারণ, গত ১০ অক্টোবর থেকে উৎপলের খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশের সাধারণ ডায়েরির ভাষায়, ‘উৎপল নিখোঁজ’।  ২৯ বছর বয়েসী একজন তরতাজা যুবকের সন্ধান মিলছে না  প্রায় দুই মাস! তার পরিবার, সহকর্মীরা বারবার ধরণা দিলেও, র‌্যাব-পুলিশ উৎপলের খোঁজ দিতে পারছে না।

যায়যায়দিন, মানবজমিন, ইত্তেফাক’র মতো প্রতিষ্ঠিত দৈনিকে কাজ করা, উৎপল এখন কর্মরত ‘রয়েছেন’ পূর্বপশ্চিম ডট নিউজ নামের একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে। তিনি গান লিখতেন, গাইতেন। তারুণ্যের খেয়াল, বাউন্ডুলেপনা ভরপুর তার জীবন। এমন একটি ছেলে দিনদুপুরে হারিয়ে গেছে। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, এ দায় কার? আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর না রাষ্ট্রের? ইংরেজি দৈনিক নিউএজ’র সাংবাদিক আহমাদ ফয়েজ লিখেছেন, “উৎপলেরা হারিয়ে গেলে/রাষ্ট্র কি আর যায় জিতে?/রাষ্ট্র তুমি ব্যর্থ কেন/নাগরিকের দায় নিতে?” আমরাও প্রশ্ন করতে চাই, একজন নিখোঁজ নাগরিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নেবে না? নাকি হারিয়ে যাওয়ার দায় বহন করবে?

chardike-ad

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাষ্ট্র একটি মানবিক সংগঠন। যার দায়িত্ব নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেউ দোষী হলে তাকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। উৎপল যদি অপরাধ করে থাকে, তবে তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার দায়-দায়িত্ব দুটোই রাষ্ট্রের। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামন খাঁন কামাল দাবি করেছেন, অনেকে তাদের বিব্রত করতে আত্মগোপন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার জবাব নয়, আমাদের বক্তব্য হলো উৎপল যদি আত্মগোপন করে থাকেন সরকারকে বিব্রত করতে, তাহলেও তার খোঁজ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

আমরা বলছি না, উৎপলকে অপহরণ করা হয়েছে। তাই আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে- এ অভিযোগও আমাদের নেই। তার পরিবার ও সহকর্মীদেরও নেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেছেন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে আটক করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালত সোপর্দ করতে হবে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরিবারকে জানাতে হবে। যেহেতু উৎপলকে আদালতে তোলা হয়নি কিংবা তার পরিবারকে কিছু জানানো হয়নি, তাই আমরা ধরে নিচ্ছি উৎপলকে কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নেয়নি। আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার, উৎপলের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  আমাদের দাবি, তাকে অবিলম্বে খুঁজে বের করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

পুলিশের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১০ অক্টোবর বেলা ১টা ৪৭ মিনিট পর্যন্ত উৎপলের মোবাইল ফোন খোলা ছিল। ১টা ৪৪ মিনিটে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপলোড করেন। তার শেষ স্ট্যাটাস ছিল, ‘ বলছিলাম নতুন ইস্যুর কথা : গ্রেফতার’। তার কয়েক মিনিট আগেই উৎপল তার মা বিমলা রানী দাসকে কল করেছিলেন। কথার এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘মা একটা জরুরি ফোন আসছে, পরে কল করব’। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ফোন বন্ধ হওয়ার আগে উৎপল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে ছিলেন। এতগুলো তথ্য পাওয়ার পরও উৎপলের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না, পুলিশের এ দাবি বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।

উৎপলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। তারা বাবা চিত্ত রঞ্জন দাস ৩৩ বছর শিক্ষকতা করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন আরও বছর সাতেক আগে। এখনও ছাত্র পড়ান।  উৎপলের বেতন তার পরিবারের ভরণপোষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই কেউ তাকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করবে, এ ধারণা যুক্তিতে খুব একটা খাটে না। তরুণ বয়েসে নিখোঁজ বা খুনের ঘটনার জন্য অনেকক্ষেত্রে প্রেমঘটিত কারণকে সন্দেহ করা হয়। উৎপল দাস ও তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে আমরা যতটা জানি, তিনি এ সংক্রান্ত কোন জটিলতায় ছিলেন না। আর্থিক লেনদেন বা ব্যবসায়িক কারণ নিয়েও তার কোন বিরোধ নেই।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, সাংবাদিকতাই হয়ত উৎপলের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, সাংবাদিকতাকেও আইন ও ব্যাকরণ মেনে চলতে হয়। সেখানে উৎপল যদি কোন ব্যতয় ঘটিয়ে থাকে, তাহলে তাকে খুঁজে বের করে বিচার করুন।

উৎপলের বৃদ্ধ বাবা-মা ছেলের জন্য পথ চেয়ে আছেন। তার মা শয্যাশায়ী। টেলিভিশনের খবরে আমরা দেখছি, উৎপলের ক্রদনরত মা ছেলে ফিরে পেতে সরকারের সহায়তার জন্য আকুতি জানিয়েছেন। উৎপলের বাবা রাজপথে নেমে চোখের জলে একই মিনতি করেছেন। এত কাকুতির পরও পুরো প্রশাসন নিরব।

একজন ২৯ বয়েসী তরুণের ‘হারিয়ে’ যাওয়ার বেদনা আমরা নিরবে সইতে রাজি নই। সাংবাদিক সমাজ রাজপথে নেমেছে। সত্য অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিকরা উৎপলের অনুসন্ধানের দাবিতে সোচ্চার থাকবে। যদি সাংবাদিকতা করার কারণেও উৎপল নিখোঁজ হন, তবু আমরা পিছ পা হবো না। আমরা বলতে চাই, উৎপলের নিখোঁজে আমরা ভীত নই, আমরা ক্ষুব্ধ।

লেখকরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক