Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কোরিয়ায় আমার পথচলা

কোরিয়ায় পা দিয়েছি ঠিক বলতে গেলে ২ মাস ১২ দিন আগে। পা রেখেই প্রথম যে ব্যাপারটায় চোখ আটকেছে বালিকার প্রথম প্রেমের মতো, তা এখানকার রাস্তা এবং উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ। প্রথম কদম রেখেই কল্পনা আর বাস্তবের মিলন কতো সুন্দর হয় তা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।

আমি বরাবরই আমার কাছের জনদের কাছে বলে এসেছি ‘প্রকৃতিই পারে মানবকে নিঃস্বার্থ শান্তি আর ভালোবাসা দিতে’, আর তাই প্রকৃতির চেয়ে মানুষের পরম বন্ধু আর কিছু হতে পারে না। তেমনি প্রকৃতির অপরূপ রূপে ভরপুর এই দেশ। যদিও এসবের মাঝে মন কেঁদে ওঠে বৃষ্টির রাতে ঢাকার চকচকে রাজপথে রিক্সায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে পড়লে। যা আর দুনিয়ার কোথাও মিলবে না। স্বদেশ স্বদেশই হয়, অস্তিত্বে জড়ানো। বয়ঃপ্রাপ্ত গুরুজন যারা দেশের বাইরে থাকেন, তারা আরো ভাল বোঝেন। তাইতো শেষ ইচ্ছেগুলোর তালিকায় ছেলেমেয়েদের কাছে শেষ ঠিকানা হিসেবে দেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে ইচ্ছে পোষণ করেন।

chardike-ad

আবার কোরিয়ার পথে ফিরে আসি। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় একই পথের রূপ একই দিনে প্রতি বেলায় বদলায়। তেমনি রাত যতই গভীর হয়, রহস্যে ঘেরা পাহাড়ি এই উঁচু নিচু পথের রূপ ততোই বেড়ে যায়। আমি একসময় ভয়াবহ অনিদ্রারোগে আক্রান্ত ছিলাম। মেডিকেলের ভাষায় যাকে ইন্সমনিয়া বলে। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে রোজ অফিসে কর্মক্ষম থাকার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমারে ঝুলিতে চির অবহেলায় রয়ে যাবে। সে অনিদ্রারোগ এখন আর না থাকলেও মাঝে-সাঝে বেড়াতে আসে। তখন কোন পদ্ধতি কাজ না করায় হাল ছেড়ে হাঁটতে বেড়িয়ে পরি। আর আমার জীবনের আগের অধ্যায়ের পাতাগুলো আপন মনে উল্টে যাই। সেই নিদ্রাহীন রাতগুলোতে আমার ঘরের ঝুল-বারান্দার গ্রিলে পা ঝুলিয়ে ঘুমন্ত ঢাকার পথ দেখতাম, আর জেগে স্বপ্ন দেখতাম, কখনো যদি এমন ঘুমন্ত শহরের রাতে পথে নামা যেতো! নিশ্চয় ঢাকার অন্য রূপ দেখতে পেতাম। কিন্তু তা বাস্তবে করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতাম না। কারণটা বোধহয় আমরা বাংলাদেশিরা খুব ভাল করে জানি।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর মতো নারী নিরাপত্তা প্রদানে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। অথচ এশিয়া মহাদেশের একই

সিউলে নারীদের নিরাপত্তায় রাতে পাহারা দেয় স্বেচ্ছাসেবকরা

ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েও চীন, ভারত, বাংলাদেশ কতো ভয়াবহভাবে নারী নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ কোরিয়ার এতো ভাল সামাজিক চিত্র কয়েক দশক আগেও ছিল না। সত্তরের দশক থেকে শুরু হওয়া সামরিক শাসনামলে অনেক বিতর্কিত কাজের মধ্যেও নারী নিরাপত্তার বিষয়টির প্রাধান্য ছিল। যার ফলাফল বর্তমান কোরীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা।

সবার উপরে তো আমরা মানব জাতি, ভুল শুদ্ধে গড়া আমাদের চারিত্রিক অবকাঠামো। এদেশে ছোট থেকে বাচ্চাদের কঠোরভাবে শেখানো হয় বড়দের আর নারীদের সম্মানের ব্যাপারগুলো। অথচ যদি আমদের দেশের দিকে ফিরে তাকাই, কঠোর শব্দটা কোথাও থাকলে তা শুধু নিয়ম ভাঙায়। এখানে কোন জাতিকে বড় করা বা নিজের দেশকে ছোট করার উদ্দেশ্যে লিখছি না, লিখছি দুঃখবোধ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের দেশ যে গতিতেই হোক না কেন উন্নতির দিকে এগিয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার হার বেড়েই চলেছে। এখন গ্রাম পর্যায়েও শিক্ষিত বাবা-মার সংখ্যাটাই বেশি। অথচ ছোট থেকে কঠোর করে ন্যায়-অন্যায় আলাদা করতে শেখায় কজনই বা। কজন বাবা-মাই বা কঠোর করে বড়দের আর নারীদের সম্মান করতে শিখিয়ে বড় করে তোলে। যেকোন ব্যক্তি, সমাজের, দেশের ভাল দিকগুলো নিয়ে নিজেরা ব্যক্তি হিসেবে বদলে সমাজের আর দেশের জন্য ভাল কিছু করার সম্ভাবনা থেকেই আমার এই লেখার প্রয়াস।

আমাদের জাতিকে ব্যক্তি জীবনে পাল্টানোর সাহস করে এমন লোকের দেখা মেলা ভার। তাই সমাজ আর দেশ বদলানো আর হয়ে উঠে না। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমরা অনেক সাহসী জাতি। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না, বিজয় আসতো না, বিশ্ব মানচিত্রে বাংলার স্বাধীনতা এতো পরিচিতি পেত না। আমাদের মাতৃভাষা দিবস গোটা দুনিয়া পালন করতে পারতো না। এতো ছোট দেশ হয়েও আমাদের ঝুলিতে কতো বড় বড় অর্জন। এখন মনে হয় সব যেন সে সময়গুলোতেই আটকে আছে। বর্তমান সময়ের ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবালদের মতো মানুসগুলো দেশ বদলানোর আপ্রাণ চেষ্টায় শুধু যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। এ যুদ্ধ নিজের সাথে বলেই হয়তো এ জয়ের জন্য এতো দীর্ঘ অপেক্ষা।

আমার খুব কাছ থেকে দেখা এমন সাদা মনের অল্প মানুষের মধ্যে ডঃ মাসুদুল কাদের অন্যতম। যিনি নামের আগে ডঃ উপাধিটাই নিজ থেকে কোনদিন বলেন নাই এবং তার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কোথাও নিজ হাতে এই সম্মান তিনি ব্যাবহার করেন নাই। ডঃ ও অধ্যাপক বাবা এবং পরিবারের অন্যদের মতোই সরকারি চাকুরে ছিলেন, ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারপরও তার স্বভাবসুলভ কারণে মুক্তিযুদ্ধে কমান্ডার হিসেবে হাজারও কষ্ট স্বীকার করে দেশের জন্য জয় নিয়ে এসেছেন। সেসব গল্পে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এমন পরিবারে ছেলে হয়েও নীতি-নৈতিকতার কারণে সারাজীবন ঝাঁপিয়ে পরেছেন একটার পর একটা সংগ্রামে। যুদ্ধের পর তার বন্ধুদল নিয়ে নৌকায় করে করে স্বাস্থ্যসেবা দিতেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড মনি সিংহ পুত্র ডাঃ দিবালোক সিংহ। সাদামনের মানুষের আরেক স্বদীপ্ত উদাহরণ যিনি। নামের যথার্থ মূল্যায়ন সারাজীবন পথে করে যাচ্ছেন।

এ মানুষগুলোর নৌকার সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র আজ আমাদের দেশে দুঃস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে সুশোভিত হচ্ছে। যা এখন অন্যতম সেরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) মধ্যে একটি। ত্যাগ হিসেবে ডঃ মাসুদ বহু আগেই ছেড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। দুঃস্থ নারী, শিশু, শিক্ষা আর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস। আমি আশাবাদি, একদিন  হয়তো এভাবেই দেশটা বদলে যাবে, আর আমি আমার দেশের গভীর রাতের মুক্তরূপ দেখব নির্ভয়ে।

লেখক: তাহেনিয়া কাদের, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া।