গত সোমবার মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন নিউইয়র্ক প্রবাসী বিলকিস আরা মিতু (২৬)। এ দুর্ঘটনা দেশে-প্রবাসে সবাইকে নাড়া দিয়েছে।নিজেদের মর্মাহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
বাদ ছিলেন না মিতুর স্বামী নিউইয়র্কে বসবাসরত আজিজুল হকও। কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিধ্বস্তের পর ফেসবুকে স্ট্যাটাসে ২৪ ঘণ্টা আগে (এ রিপোর্ট লেখার সময়) নিজের মর্মাহত হওয়ার কথা লেখেন আজিজুল। তিনি এখনও জানেন না, তারই প্রিয়তমা স্ত্রী মিতু সেই বিমানেরই যাত্রী ছিলেন।
রাজশাহীর শাহ মাখদুম থানার সপুরা এলাকার নওদাপাড়া রোডের মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া ও মনোয়ারা বেগমের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মিতু ছোট। তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিসি-০০৪৯০৩০। নিউইয়র্কের হাডসনে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতেন মিতু। দিন কয়েক আগে মায়ের অসুস্থতার কারণে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এরপর সোমবার নেপালে বেড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি।
সোমবার নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়ে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত ও ২১ জন আহত হন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় থাকার সুবাদে মিতু ছিলেন নিউইয়র্কে অনেকের পরিচিত। তার মৃত্যু সংবাদে নিউইয়র্কের ঘনিষ্ঠজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মিতুর স্বামী আজিজুল হক ফায়ারম্যানস এসোসিয়েশন অব দ্য স্টেট অব নিউইয়র্কের স্টাফ নার্স।
ফেসবুকে এক পোস্টে আজিজুল হক লিখেছিলেন- ‘মাঝে মাঝে কিছু সকাল অভিশপ্ত মনে হয়। তেমনি একটা সকাল শুরু হল দুটি অত্যন্ত বাজে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ দিয়ে। ঢাকার মিরপুর-১২ আগুনে পুড়ে তছনছ, আবার ইউএস-বাংলার একটি বিমান নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিধ্বস্ত হয়েছে যাতে অনেক বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
গত ১১ মার্চ ভোর ৩টা ২৩ মিনিটে নিজের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করে স্ট্যাটাস দেন মিতু ইসলাম। সেখানে তিনি লিখেন, ‘আহা পারিতাম, যদি পারিতাম/ আঙুলগুলো ছুঁয়ে থাকতাম/ বিষাদের জাল, টালমাটাল/ এ কোন দেয়াল, এ কোন আড়াল/ ছাই হয় গোধূলি, কারে যে বলি/ এ কোন শ্রাবণ পথে হয়ে চলি…।’
বিমান দুর্ঘটনার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও মিতু ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন। মিতুর নিউইয়র্ক প্রবাসী এক বান্ধবী রোববার দিবাগত রাত ১২টা ৪৬ মিনিটে অর্থাৎ সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ৪৬ মিনিটে নিজের কয়েকটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। তার কিছুক্ষণ পরেই ওই পোস্টে কমেন্ট করেন মিতু। তিনি লিখেন, ‘ওয়াও, লাভলি অ্যান্ড স্মার্ট অ্যান্ড কিউট’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিতুর ওই বান্ধবী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিউইয়র্ক প্রবাসী ওই বান্ধবী বলেন, ‘মিতুর এক ভাবী কিছুক্ষণ আগে আমাকে বিমান দুর্ঘটনার খবরটি জানিয়েছেন।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল আমি ফেসবুকে কয়েকটি ছবি পোস্ট করার পর দ্বিতীয় কমেন্টটি ছিল মিতুর। এরপর আমি তার সাথে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলি। কিন্তু সে যে এভাবে চলে যাবে ভাবতে পারছি না।’ জানা গেছে, আর দুদিন পরই মিতুর জন্মদিন। ১৫ মার্চ জন্মদিনটি তার ঢাকায় বাবা-মা ও একমাত্র ভাইয়ের সঙ্গে পালন করার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই এ করুণ পরিণতি!
পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে নিউইয়র্ক প্রবাসী মার্কিন নাগরিক আজিজুল হককে বিয়ে করে পরের বছর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান মিতু। গ্রীনকার্ডধারী মিতু গত বছর দেশে গিয়েছিলেন। কথা ছিল মার্কিন পাসপোর্ট পাওয়ার পর আবার দেশে যাবেন। কিন্তু হঠাৎ পারিবারিক কারণে তিনি ঢাকা যান। সেখান থেকে ১২ মার্চ সোমবার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে নেপালের কাঠমান্ডু রওয়ানা দেন।
নিউইয়র্কে আসার পর স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে একাউন্টিং এন্ড ফিনান্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন মিতু।
মিতুর একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, আজিজুল হক স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন। স্ত্রী ছাড়া কিছু বোঝেন না। নিউইয়র্কে একটি বাড়ি থাকার পরও স্ত্রী মিতুর পছন্দে গত বছর আরও একটি বাড়ি কিনেছিলেন। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনা সব কিছু কেড়ে নিল। নিউইয়র্কের হাডসনে সাজানো গোছানো সেই বাড়িটিতে আর কোনোদিন ফিরবেন না বিলকিস আরা ওরফে মিতু ইসলাম।
মিতুর ভাই গোলাম মাসুদ রানা বলেন, আমরা মঙ্গলবার সকালে মিতুর দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। কিন্তু বাবা-মা রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসবেন, তাদের আমার বাসায় আনতে হবে- এজন্য নেপাল যেতে পারিনি।
এদিকে, বিলকিস আরা ওরফে মিতু ইসলামের স্বামী আজিজুল হক এখনও মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার খবর জানেন না। মিতুর ভাই মাসুদ রানা জানান, ‘আজিজুলের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। সে সম্ভবত এখনও মিতুর নিহত হওয়ার খবর জানে না।’
আজিজুলের এক প্রতিবেশি বলেন, ‘কাল রাতেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে, আমরা তাকে মিতুর খবর জানাইনি, তিনিও কিছু জানেন না।’
তবে তার অন্য এক প্রতিবেশি বলেছেন, আজিজুল সম্ভবত মিতুর খবর জেনে গেছেন। তাই ফোন ধরছেন না। তাকে বাসায় কিংবা কর্মস্থলে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
বারবার ফোন করা হলে এই প্রতিবেদকের ফোনও ধরেননি আজিজুল হক।
সুত্রঃ যুগান্তর