নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস চেকিংয়ের খপ্পড়ে পড়ে চালক ও মালিকদের টনক নড়েছে। শিক্ষার্থীদের মাত্র ৭ দিনের অভিযানেই বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিতে (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস সনদ পেতে হিড়িক পড়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন শুরুর পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে। আর গত কয়েক দিনে লাইসেন্সসহ বিভিন্ন বৈধ ডকুমেন্ট তৈরির আবেদন বেড়েছে তিনগুণ। ভিড়ের কারণে অনেকেই আবেদনপত্র জমা না দিতে পেরে ফিরে গেছেন।
সরেজমিন মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চালক ও গাড়ির মালিকদের উপচেপড়া ভিড়। গাড়ি আর লোকজনের সমাগমে স্বস্তিতে দাঁড়ানোর মতো জায়গা নেই। লাইসেন্স নবায়ন ফি, শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ও গাড়ির ফিটনেস সনদ পেতে দীর্ঘ লাইন। প্রাইভেটকারের লাইন প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে ঠেকেছে পুলিশ কনভেনশন সেন্টারের সামনে। আর ভেতরে মোটরসাইকেলসহ অন্য গাড়ির জন্য চলাচল করাই কষ্টসাধ্য। সরকারের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, আগে প্রতিদিন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য গড়ে ১১০টির মতো আবেদন পড়ত। এখন প্রতিদিন পড়ছে প্রায় ৩শ’ থেকে ৪শ’টির মতো। নবায়নের জন্য আগে ৫০টি আবেদন পড়ত, এখন পড়ছে শতাধিক। ফিটনেস সনদ নিতে আগে প্রতিদিন আবেদন ৯শ’র মতো পড়লেও এখন পড়ছে ২ হাজার। এ ছাড়া মালিকানা পরিবর্তন, ডিজিটাল নম্বর প্লেট, ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি কাজেও আবেদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। তবে এই চাপ সামলানোর জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।
এদিকে ফি জমা দেয়ার জন্য কাউন্টারে ভিড় আগতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রাইভেটকারের বেশিরভাগই এসেছে ফিটনেস সার্টিফিকেট আর মালিকানা পরিবর্তনের জন্য। অনেকেই এসেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স, কেউ বা ডিজিটাল নম্বর প্লেট, ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড করতে। অনেকেই এসেছেন লার্নার কার্ডের জন্য। প্রতিটি বুথেই ছিল ভিড়। সকাল থেকেই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন সেবা গ্রহীতারা। হঠাৎ বাড়তি লোকের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
বিআরটিএর উপপরিচালক মো. মাসুদ আলম জানান, আমরা স্পেশাল ড্রাইভ দিচ্ছি। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরুর পর থেকে আমাদের ৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করছে। সব মিলিয়ে গত ৩ দিনে ব্যাপক আবেদন পড়েছে। বিআরটিএ এটাকে সাফল্য দেখলেও গ্রাহকরা এটিকে ভোগান্তির অপর নাম বলছেন। তাদের বক্তব্য, এখানে কোনো কাজই সময়মতো হয় না। ছোটখাটো ভুল বা তুচ্ছ কারণে দিনের পর দিন এখানে ঘুরতে হয়। মূলত এসব কারণেই অনেকেই বৈধ কাগজপত্র করতে চান না।
মিরপুরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম শান্ত বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের লার্নার কার্ড করতে সকাল ৭টায় এসেছি। এখনো সামনে ৩০-৪০ জন আছে। পেছনে রয়েছে প্রায় ৪-৫শ’ লোক। অথচ অনেকেই দালালদের কিছু টাকা দিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছে। সংস্থাটির অনিয়ম নিয়ে তিনি বলেন, বৈধ কাগজপত্র নিয়ে সড়কে যানবাহন চালানোই তো নিয়ম। এ ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স করা মানে সেটা তো একটি কাগজ নয়। পরীক্ষার মধ্য দিয়ে লাইসেন্স নিতে হয়। কাজেই এখানে সড়কের নিয়ম মানার একটা শিক্ষার বিষয় থাকে। তাই এটা করাটা জরুরি। ভোগান্তি যা হচ্ছে এটা লোকবলের অভাবের কারণে।
বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালত, ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলা না আসার পেছনে জনসাধারণের ইচ্ছার ঘাটতিও দায়ী। তিনি আরো বলেন, যিনি গাড়ি চালান দায়িত্বটা তার নিজের। তিনি নিজে ঠিক না হলে আইন দিয়ে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা দুরূহ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা চলমান আন্দোলনে জনসাধারণের সঙ্গে বাজে আচরণ না করেও যে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ট্রাফিক পুলিশও তার গাড়ির কাগজ না রাখায় তাকে মামলা দিতে বাধ্য করেছেন। উল্টো পথযাত্রী মন্ত্রীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
গাড়ি আটকে থানায় দিয়েছেন। তাদের এমন কর্মযজ্ঞে সবার মানসপটেই এক শৃঙ্খলার রূপরেখার উদয় হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার তো বলেই দিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে ট্রাফিক সপ্তাহ। এই ট্রাফিক সপ্তাহের অভিযানের প্রথম দিনেই ২২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে গাড়ির চালকদের। রাজধানীতে ট্রাফিক আইন অমান্য কারায় ৪ হাজার ৭১৭টি মামলা করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
গতকাল দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব মামলা ও জরিমানা আদায় করা হয়। এ সময় ৩১টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৫১৬টি গাড়ি রেকার করা হয়।
ট্রাফিক সূত্রে জানা যায়, উল্টো পথে গাড়ি চালানোর কারণে ৩৫৯টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা, হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করার দায়ে ১৪টি, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার করার জন্য ২টি এবং মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহারের জন্য ৯টি গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও এ সময় ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে ২ হাজার ৩১০টি মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা ও ৯১টি মোটরসাইকেল আটক করা হয়। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করায় ৪২টি মামলা ও সরাসরি ৮টি মামলা দেয়া হয়েছে।