Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

টাকা খরচ করলে সবকিছুই পাওয়া যায় বরিশাল কারাগারে!

barishal karagarটাকা খরচ করলে সবকিছুই পাওয়া যায় বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে। শুধু খরচটা বাইরের চেয়ে দ্বিগুণ। বন্দিদের দাবি, টাকা থাকলে কারাগারে রাজকীয়ভাবে বসবাস করা সম্ভব। ভালো খাবার থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য সবই পাওয়া যায় সেখানে। মাদক বিক্রি এবং বন্দিদের কাছ থেকে টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের অনুগত ১০ থেকে ১৫ কারারক্ষী। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া একাধিক বন্দির সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই কারাগারে সকল ধরনের নেশা প্রবেশ করে।  কারাগারের বাইরে আইনি ঝামেলা থাকলেও ভেতরে মাদক বিক্রি এবং সেবনে কোনও ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না। আরসি কিংবা কোকাকোলার বোতলে করে ভেতরে পাঠানো হয় ফেনসিডিল। আর মিনারেল ওয়াটারের বোতলে পাঠানো হয় সাদা (ওয়াটার কালার) রংয়ের মদ। এছাড়া ইয়াবা, গাঁজা ও ঘুমের ওষুধ সহজেই পাওয়া যায় কারাগারে। তবে দামটা বেশি দিতে হয়। বাইরে ফেনসিডিল ১৭শ’ টাকা হলে কারাগারের ভেতরে সেটা সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একইভাবে গাঁজা, ইয়াবা, ঘুমের ওষুধ বন্দিদের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে দাম হাঁকেন রক্ষীরা।

chardike-ad

শুধু নেশাদ্রব্যই নয়, আমদানি ওয়ার্ড থেকে বন্দি বেঁচাকেনা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার সময় অর্থ আদায়, আর্থিক চুক্তিতে সুস্থ বন্দিকে অসুস্থ সাজিয়ে কারা হাসপাতালে রাখাসহ বিভিন্ন অনিয়মের ওপর ভর করেই চলছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার।

বরিশাল আদালতে হাজিরা দিতে আসা হাজতিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বন্দিরা প্রথম দিন কারাগারে গেলে তাদের রাখা হয় আমদানি সেলে। পরে প্রয়োজনীয় অর্থ দিলে পাওয়া যায় হাসপাতাল কিংবা তুলনামূলক ভালো ওয়ার্ডে থাকার সুবিধা। বন্দি সাক্ষাতের সময় তাদের স্বজনদের কাছ থেকে বখশিসের নামে ৫০ থেকে ১০০ টাকা এমনকি এক প্যাকেট বেনসন সিগারেটও আদায়ের অভিযোগ রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত রক্ষীদের বিরুদ্ধে। প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার টাকার চুক্তিতে সুস্থ বন্দিদের অসুস্থ সাজিয়ে রাখা হয় তুলনামূলক আরামদায়ক জায়গা কারা হাসপাতালে।

জামিনে মুক্তি পেয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক বন্দি বলেন, ‘কারা হাসপাতাল কোনও অসুস্থ বন্দির জায়গা নয়। বিত্তবান সুস্থ বন্দিরা টাকার বিনিময়ে অসুস্থ হয়ে আয়েশে থাকেন সেখানে। কারা হাসপাতাল আর আবাসিক হোটেলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।’ কারাগারে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকও হাতের নাগালে পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।

কারাসূত্রে জানা যায়, খাবার তালিকা অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে একজন কয়েদি ১১৬ গ্রাম ও হাজতির জন্য ৮৭ গ্রাম আটার রুটি এবং ১৪ গ্রাম আখের গুড়, দুপুরে কয়েদির জন্য ২৯১ গ্রাম ও হাজতির জন্য ২৪৭ গ্রাম চালের ভাত, ডাল, সবজি এবং ২৯ গ্রাম ওজনের মাছ অথবা মাংস দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। রাতেও প্রায় একই রকমের মেন্যু। প্রতিমাসে ২০ দিন মাছ এবং ১০ দিন মাংস খাওয়ানোর নিয়ম রয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে আবার ৪ দিন গরু, একদিন খাসি এবং ৫ দিন মুরগির মাংস খাওয়ানোর কথা।

বন্দিদের দাবি, খাবারের এসব মেন্যু তালিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখানে খাবারের মাপে কম দেওয়াসহ নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। রক্ষীদের নির্যাতনের ভয়ে কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করেন না।

কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া হাজতি মাসুদ হাসান জানান, ‘কারাগারে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের। ভাত থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। তরকারি মুখে নেওয়ার মতো না। মাছ-মাংসও মানসম্পন্ন নয়। হাসপাতালের রোগীদের গরুর দুধের বদলে গুড়ো দুধ গুলে খাওয়ানো হয়।  যারা আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তারাই নিরুপায় হয়ে ওই খাবার খেয়ে থাকেন। স্বচ্ছল বন্দিরা কারাগারের কেন্টিন থেকে অর্ডার দিয়ে পছন্দের খাবার খান।’

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া বন্দিদের মাধ্যমে জানা যায়, কারাগারে রেশনের দায়িত্বে রয়েছেন কারারক্ষী মামুন মিনা (ব্যাচ নং-৪১৬৪০)। গত ৭ বছর ধরে সরবরাহকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে ওজনে কম এবং নিম্নমানের রেশন গ্রহণ করে তা বেশি দামে হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত করে আসছেন তিনি। কারারক্ষী উজ্জ্বল মিয়ার (ব্যাচনং-৪১৮৪১) দায়িত্ব  কারাগারের বাইরের ক্যান্টিনে। সেখানে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করা হয়। হাজতির ভর্তি ও মুক্তি শাখায় কর্মরত রয়েছেন সুমন দত্ত (ব্যাচ নং-৪১৯৮৩) এবং রুহুল আমিন (ব্যাচ নং-৪১৭৮৬)। দীর্ঘদিন ধরে তারা একই পদে বহাল রয়েছেন। আর কারাগারের ভেতরের ক্যান্টিনে প্রতিমাসে ২৫-৩০ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি হয় তাদের মাধ্যমে। কারা মহাপরিদর্শকের গোয়েন্দা কারারক্ষী জুয়েল (ব্যাচ নং-৪২৩২১) টাকার বিনিময়ে এখানের কোনও তথ্য মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ে পাঠান না। এভাবে ১০-১৫ জন কারারক্ষী নিয়মিত কারাগারে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে।

এছাড়া প্রতিদিন আদালত থেকে জামিনে বের হওয়ার সময় নামের বানানে ভুল কিংবা শারীরিক সনাক্তকরণ চিহ্নে সমস্যা, পিতার নাম কিংবা ঠিকানা ভুল অজুহাতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা করে আদায় করা হয়। কারাগারের অভ্যন্তরে অবস্থানরত আসামিদের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতের (অফিস কল) নামে ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। কারা অভ্যন্তরের মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য ৪২ জনের রোগীর সজ্জা থাকলেও সেখানে ভর্তি করা রয়েছে ২০০-২৫০ জনকে। প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদেরকে সেখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতিমাসে বিভিন্ন খাত থেকে আদায় করা টাকা যাচ্ছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কারারক্ষী পর্যন্ত। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিমাসে অনৈতিকভাবে ১০ লাখ টাকা আয় রয়েছে। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি কারা পরিদর্শক কারাগারের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এটা একদিনে হয়নি। বহুকাল ধরেই অনিয়মের ওপর ভর করে চলছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’

বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক সকল অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, কারাগারের ভেতরে মাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে তারা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোনও মাদক উদ্ধার হয়নি বলে তিনি জানান। টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

বরিশালের জেলা প্রশাসক ও কারাগার পরিদর্শন কমিটির সভাপতি এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘বন্দিদের খাবারের মান উন্নত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্দি সুস্থ না অসুস্থ্য সেটা একজন সিভিলিয়ানের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই কোন বন্দি কারা হাসপাতালে থাকবেন সেটা দেখেন কারা চিকিৎসক।’

মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক জানান, ‘কোনোভাবেই যেন কারাগারে মাদক প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তদারকি বাড়ানো হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে কারও সংশ্লিস্টতার অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’