Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শেষে যেন না বলিস মুক্তিযুদ্ধই হয়নি

takurমুক্তিযুদ্ধ সরকারের ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি হলেও এ নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কই এখনো তুঙ্গে। বলতে গেলে হয়তো এমন একটি দিনও পাওয়া যাবে না যেদিন এসব বিতর্ক স্থান করে নেয়নি। বিতর্কে সূত্রে প্রকৃত প্রস্তাবে সরকার বা সরকারি মহলই অবস্থান করছে। ‘৯০Ñএর গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে এক ধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও তখনও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলমান বিতর্কে কমতি ছিল না।

গত কিছুদিনে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বিতর্কে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাই প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। পুরনো বিতর্ক ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে। এখন কেন্দ্রীয় কমান্ড ও সনদ নিয়েই বিতর্ক উঠেছে। চলমান বিতর্কে একজন সেক্টর কমান্ডার যার চাকরিকালীন পদোন্নতি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের উপ সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকারকে এখন আর মুক্তিযোদ্ধা বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি কে এম সফিউল্লাহ। তিনি বলেছেন, একে খন্দকার ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বই লিখে মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করেছেন। যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস রচনা করতে পারেন, তিনি আর মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারেন না। তার এই বক্তব্যের পর প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

chardike-ad

মুক্তিযুদ্ধের সেই সময় সম্পর্কে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকার লিখেছেন, “আগরতলা পৌঁছে আমি মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শওকত আলী প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরদিন জেনারেল কালকাত সিং এবং আমি মেজর শাফায়েত জামিলসহ কোলকাতায় যাই। ওখানে পৌঁছে আমি কর্নেল ওসমানীর (পরে জেনারেল) সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কোলকাতায় তাঁর সাথে দু‘দিন থাকার পর তিনি আমাকে ঊর্ধ্বতন ভারতীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য দিল্লি যাওয়ার নির্দেশ দেন। …দিল্লি থেকে কোলকাতা ফেরার পর কর্নেল ওসমানী আমাকে জানালেন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আমাকে সরকারে সমি¥লিত সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত করেছেন। সংসদ সদস্য কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) রবকে রাজনৈতিক কারণে চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে। …যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর বেশির দায়িত্ব আমার ওপরই ন্যস্ত ছিল।”

যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ট্রেনিং ও অপারেশনের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তিনি লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের সামরিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নির্ধারণ করা হয়। …কমান্ডার-ইন-চিফÑএর তরফ থেকে সেক্টর কমান্ডারদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। পরে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেক্টর কমান্ডারই নির্ধারণ করতেন কোন দায়িত্ব তিনি কেমন করে সম্পন্ন করবেন। সমগ্র এলাকাকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করার ফলে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর  সমন্বয় সাধনে সক্ষম হই।”

সশস্ত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল এম এ জি ওসমানী সুষ্ঠুভাবে মুক্তিযুদ্ধি পরিচালনার জন্য সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেন। মেজর কেএম সফিউল্লাহ প্রথমে ৩নং সেক্টরে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি কার্যত তার নিয়োগ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলেছেন তার ফলে তার যুদ্ধ ও প্রকৃত প্রস্তাবে বিতর্কিত হয়ে গেল। সেই সাধে ডেপুটি চিফ অব স্টাফই যদি মুক্তিযোদ্ধা না হন তাহলে কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাদের প্রকৃতি ও পরিচয় কী সে প্রশ্নও গুরুতর বিবেচ্য বিষয়। প্রাথমিক পর্যায়ের জয়দেবপুর প্রতিরোধকারী হিসেবে পরিচিতি রয়েছে জনাব সফিউল্লার। সে সময়ে তিনি ২ ইবিআরের সেকেন্ড-ইন কমান্ড ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষের সাক্ষাৎকারভিত্তিক শর্মিলা বসুর ডেড রেকনিংÑএ বলা হয়েছে, এ প্রতিরোধ যুদ্ধের যে বর্ননা তিনি দিয়েছেন তা হল, মেজর মইনুল ও অন্যান্যদের কাছ থেকে যা শুনেছিলেন তাই। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে ওই বইয়ে বলা হয়েছে, “মেজর সফিউল্লাহ মনে করেন ব্যারিকেডের স্থানে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হতো যদি শুধুমাত্র বাঙালি কর্মকর্তাদের ধৈয্য ও কৌশলের সাথে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দেয়া হতো।” যিনি তার জীবনের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের বিবরণ লিখেছেন শুনে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন এমন একজনকে যিনি ছিলেন নেতৃত্বে এবং যার ভূমিকা ও অবস্থান নিয়ে এর আগে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যে পদে এখন সফিউল্লাহ রয়েছেন সেখানে মাত্র সেদিনও তিনি ছিলেন। তার বই নিয়ে যদি কোনো আলোচনা থাকে তাহলে তা বই লিখে মোকাবিলা না করে বা করার সাহস না রেখে যুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হাস্যকর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

জনাব সফিউল্লাহ এখন যে পদে রয়েছেন এ পদে থেকেই তার এক পূর্বসূরি সেক্টরস কমান্ডাস ফোরামকে ব্যবহার করে ডেসটিনির দুর্নীতির পক্ষে তদরির করতে গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রীর কাছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে কোনো সার্টিফিকেট তিনি দেননি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সনদ জালিয়াতির মতো ঘটনা কিভাবে কেমন করে ঘঠেছে তা নিয়েও তিনি বা তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন কোনো মন্তব্য করেনি। সে বিবেচনায় জনাব সফিউল্লাহ এ কে খন্দকারকে নিয়ে যে বিতর্ক তুলেছেন তা কার্যত বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী একটি বই লেখা শুরু করেছিলেন। অর্ধেকটা লিখেছিলেনও। ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত না হলে হয়ত তার বইটি প্রকাশিত হোত। অনেক বিতর্কের অবসান হোত। ছাত্র রাজনীতির সূত্রধরে কিছুদিন তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল। তিনটি বিষয়ে আলোচনা উঠলে তিনি কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তাকে স্বীকৃতি না দেয়ার বিষয়কে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবমাননা বলে বিবেচনা করতেন। একজন জেনারেল পেনশন না দেয়ায় অমৃত্যু তিনি পেনশন গ্রহণ করেননি। ১৬ ডিসেম্বরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকতে না পারাকে মুক্তিযুদ্ধের উপর বড় ধরনের আঘাত মনে করতেন তিনি। সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে তাকে এমন এক মন্ত্রণালয় দেয়া হয়েছিল যার কোনো কাজ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী তিনি নিজ তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলবেন। কার্যত স্বীকৃতিহীনভাবেই বিদায় নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। স্বীকৃতি পাননি মেজর জলিলও। ১৬ ডিসেম্বরের কদিন পরেই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন বাংলাদেশি পণ্য ভারতে পাচারের প্রতিবাদ করার কারণে। যে কণ্ঠে জাতি স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছিল সেই জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে অইএসআইÑএর চর। আলোচ্য প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী শাসনামলে। অথচ মুক্তিযুদ্ধকে তারা ‘মহিমান্বিত’ করতে চান। রণাঙ্গনের যোদ্ধা, যুদ্ধ পরিচালনাকারিরা যদি প্রকৃত যোদ্ধা না হন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগত যে বিতর্ক রয়েছে তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই।

প্রতিটি বিষয়ের ঘটনা এবং চেতনাগত বিষয় রয়েছে। ঘটনা দৃশ্যমান। কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কারা সমর্থন করেছেন, কারা বিরোধিতা করেছে এনিয়ে খুব একটা বিরোধের অবকাশ নেই। সরকারের কোনো কোনো মহল যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলছে, আলোচনা করছে তাতে প্রকৃতই প্রশ্ন উঠতে পারে আদৌ মুক্তিযুদ্ধই হয়েছে কিনা চেতনার বিবেচনাগত ভিন্নতাকে জীবনবাজি রাখা সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে বিবেচনায় নেয়া প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কতটা সুবিচার করা হচ্ছে তার আলোচনা কোনো মতেই বাইরে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যা কার্যত ‘৪০Ñএর লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই নিহিত ছিল তা ‘৪৭Ñএর পাকিস্তান-ভারত সৃষ্টির সময়ই হতে পারত। ভারতীয় কংগ্রেসী সাম্প্রদায়িক হিন্দু নেতাদের বিরোধিতা না থাকলে সে সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে কোনো সমস্যা ছিল না। যত ধরনের বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টাই হোক না কেন ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অভ্যূদয় নিয়ে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই। সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন সে বিতর্ক যতই তীব্র করা হোক না কেন, এ দেশের প্রতিটি নাগরিকই স্বীকার করবেন জিয়ার কণ্ঠেই সে ঘোষণা শুনেছে।

জিয়া যখন একদলীয় ব্যবস্থার অবসানে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়নে বিএনপি গঠন করলেন তখনই তিনি প্রতিপক্ষের রোষে পতিত হলেন। এহেন অরাজনৈতিক শব্দ নেই যা জিয়া বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি হচ্ছে না। এই বিরোধিতা আর মুক্তিযুদ্ধের সরকারি বিশ্লেষণের মধ্যে সামজ্ঞস্য রয়েছে। দেশের রাজনীতির মাঠের দিকে তাকালে যে কেউ অনুভব করতে পারবেন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয়ের কারণে বাস্তব অবস্থা কী দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ¿ নিয়ে সরকার যা ভাবছে বা যেভাবে ভাবছে এর বাস্তব এবং চেতনাগত দিকের সাথে কার্যতই দেশের অধিকাংশ জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই অথবা মতভিন্নতা রয়েছে।

জনাব শফিউল্লাহ একে খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকে যেভাবে মুছে ফেলতে চেয়েছেন তা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরং প্রমাণিত হচ্ছে যে এই প্রক্রিয়া আরো অব্যাহত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণ অস্বীকারের প্রবণতায় এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। কার্যত এটি হচ্ছে, ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৬ ডিসেম্বর। সেই দিন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানিকে উপস্থিত না রাখা এমনকি একে খন্দকারের মতো ব্যক্তিত্বকেও সেখানে বসতে দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা না করার মধ্যে দিয়েই ভারতীয়দের যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছিল শফিউল্লাহর বর্তমান বক্তব্যে তারই প্রতিধ্বনি ঘটছে।

শেষ করতে চাই সাওতাল বিদ্রোহের একটি আলোচিত বিবরণ দিয়ে। উৎপাদিত ফসলের একটি অংশ  বাদ দিয়ে মূল্য নির্ধারণের কথা থাকায় দেখা গেল মাপের ইউনিট আর কখনোই সে ঘর অতিক্রম করছে না। সাওতাল কৃষক মনের কষ্টে মাপুইয়াকে বলছে, এরপর তুই না বলিস আমি ধানই করিনি? জনাব সফিউল্লাহসহ অনেকের কথা শুনে মনে হয়, বাংলাদেশে বোধহয় মুক্তিযুদ্ধই হয়নি। বাংলাদেশ বির্নিমাণে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বির্নিমাণ জরুরি।

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: সিনিয়র সাংবাদিক।

নতুনবার্তা থেকে নেওয়া।