Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আসুন এই আন্দোলনে অন্তত এক হই

 

লাখো শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয়ের পর প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশে যতগুলো যৌক্তিক গণআন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে সাম্প্রতিক “নিরাপদ সড়ক এবং হত্যাকারীর বিচার” চেয়ে স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের আন্দোলন একটি অনন্য, চিন্তার রাজ্যে ঝড় তোলা এবং হৃদয়ে শক্তি সঞ্চারনের একটি ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। অভিনন্দন এবং হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা তোমাদের জন্য হে প্রিয় অনুজেরা, অভিনন্দন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে জড়িত সচেতন ছাত্রসমাজকেও।

chardike-ad

সঙ্গত কারণেই এই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রেক্ষিত সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা বাতুলতা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন ঘুনেধরা রাষ্ট্রের পোস্টমর্টেম এবং ডায়াগনসিস করে কিছু অপ্রিয় সত্যকেই আমাদের সামনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে প্রমাণসহ দেখিয়ে দিয়েছে। এগুলোকে পার্সোনালি নেয়ার কিছু নেই বরং সামগ্রিকভাবে এর দায় আমরা কেউই এড়াতে পারিনা। রাষ্ট্রের ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করা নয় বরং তারা আমাদের ১৮ কোটি মানুষকেই একটা মেসেজ দিতে পেরেছে যে আমাদের ভুলগুলো কোথায় এবং আন্তরিকতা থাকলে এই সমস্যাগুলো এড়ানো যায়। ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বলেছেন যে উনি শিক্ষার্থীদের ৯টি দাবিই নিঃশর্তভাবে মেনে নিয়েছেন। এটি আমার কাছে একটু ম্যাচুউরড সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে তবে সরকারপ্রধানকে ওনার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে এবং অনতিবিলম্বে। এই গণদাবিগুলো নিয়ে ২০১৮ এর বাংলাদেশে এসে বাচ্চাদের আন্দোলন করতে হয় এটা আমাদের জন্য যে কতটা লজ্জার তা স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা প্রত্যেকটি দল এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণের আত্মসমালোচনায় নিয়ে আসা খুব জরুরী। যাই হোক, একজন সচেতন ও বিবেকবান এবং দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এই আন্দোলনের কিছু শিক্ষা এবং করণীয় নিয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করবো এই লেখায়।

প্রথমতঃ সরকারের একজন মন্ত্রী আমাদের জাতীয় পতাকাবাহী একজন ব্যক্তি। যোগ্যতার বিবেচনা আপনাদের কাছে কিন্তু তাঁদের অপমান মানে আমাদের রাষ্ট্রের অপমান। রাষ্ট্রের কোন নাগরিক এই ধরণের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের কাছে নূন্যতম ইমম্যাচুউরড, বালখিল্যতা এবং অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ প্রত্যাশা করে না। সুতরাং যতদিন ওই পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ছেন অনুগ্রহ করে নিজের সম্মান রক্ষা করে চলুন, রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে নিজেকে সমর্পন করুন। জনগণকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয় বরং প্রকৃত ক্ষমতার আপাত মালিক হিসেবে তাঁদের সম্মান করুন। আপনারা আছেন, অতীতেও অনেকে ছিল আবার ভবিষ্যতেও অনেকে আসবে। কাজেই অহংকার এবং গোয়ার্তুমি ছেড়ে দিয়ে জনগণের পালস বোঝার চেষ্টা করুন নইলে জনগণ যেকোন সময় আপনাদের ছুঁড়ে ফেলতে সময় নিবে না।

দ্বিতীয়তঃ আমি নিজে সহ আরো অনেকেই এই প্রজন্ম নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ওরা দেখিয়ে দিয়েছে যে দেশমাতৃকার যেকোন প্রয়োজনে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এটা খুব পজিটিভ সাইন। যে দেশে আর ঘুরে যাবোনা বলে মনে মনে স্থির করেছিলাম সেই চিন্তাকেও এরা পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবে ছাত্রদের কাছে একটি সভ্যসমাজ আরেকটু দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে প্রিয় ছোট ভাই-বোনেরা। অশ্লীলতা, গালিগালাজ এগুলো আর কোনোদিন নয়। আমি আশা করবো তোমরা দেশের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে অশ্লীল গালিগালাজের জন্য, এটা মারাত্মক অনাকাঙ্ক্ষিত। এই ক্ষমা চাওয়াটাই তোমাদের অনেক বড় করে দিবে। পুলিশতো আলাদা কেউ নয়। তোমার আমার পরিবারের সদস্যই তো তারা, আমার নিজের পরিবারেই তো পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছে। তাদের শত ভুল-ত্রূটি আর সীমাবদ্ধতার পরেও আমাদের তো তাদের কাছেই নিরাপত্তার জন্য শরণাপন্ন হতে হবে। তোমরা যার যার ক্লাসে ফিরে যাও, জ্ঞান অর্জন করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করো। সরকার দ্রুত তোমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন না করলে আবার সকলে মিলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নেমে আসবে।

 

তৃতীয়তঃ প্রিয় পুলিশবাহিনী, আপনাদের স্লোগান তো, “পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ” কাজেই মনেপ্রাণে এই স্লোগানটিকে ধারণ করা উচিত। কোন দলের পদলেহন নয়, সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী নয় বরং জনগণের সেবক হয়ে সততা, দায়িত্বশীলতা এবং পেশাদারীত্ব নিয়ে আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করে গেলে দেশের জনগণ আপনাদের ভালোবেসে আর শ্রদ্ধায় মাথায় তুলে রাখবে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে নিজেদের সন্তানদের জন্য হলেও একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা আরও জোরালো হবে এমনটা প্রত্যাশা করা বোধ হয় অত্যুক্তি করা হবে না। জনগণকে আইন মেনে চলার জন্য আপনাদের নিজেদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা খুব জরুরি। অন্যায়ভাবে মানুষকে হয়রানি করা, জুলুম করা, ঘুষের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পিটিয়ে আহত করা, টিয়ারশেল আর রাবারবুলেট ছুঁড়ে আন্দোলনকারীদের আহত করা, মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা, প্রকৃত এবং প্রকাশ্যে অপকর্ম করা অপরাধীদের আইনের আওতায় না নিয়ে নিয়ে এসে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাওয়া, নিরপরাধ মানুষকে গুম করে ফেলা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা ইত্যাদি এই প্রত্যেকটা অভিযোগে অভিযুক্ত আপনারা। যারা এগুলোর সাথে জড়িত তাদের শাস্তি নিশ্চিত করে এবং এগুলো থেকে দূরে সরে এসে প্রকৃতভাবেই জনতার কাতারে সেবক হিসেবে দাঁড়ালে আপনারা আমাদের চোখের মনি হয়ে থাকবেন।

চতুর্থতঃ রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা ভুলেই যান যে জনগণ তাদের আজীবনের জন্য শাসন করার লীজ দেয়নি। আজ আছেন, কালকে নাও থাকতে পারেন। কাজেই পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ব্যাক্তিদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না প্লিজ। অযোগ্য এবং দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি এবং আমলাদের সরিয়ে এবং প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিয়ে জনমুখী এবং জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলুন। ভোট চাইতে হবেনা, ভালো কাজের জন্য জনগণ আপনাদের নিজে ভোট দিয়ে আসবে। শত অভিযোগের তীরে বিদ্ধ নৌমন্ত্রী শাজাহান খাঁন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সাহেবদের মতো লোকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে যোগ্য লোকদের ক্ষমতা দিলে আপনাদের কোনো ক্ষতিই হবেনা বরং জনগণ বাহবা দিবে নিঃসন্দেহে। রাষ্ট্রের সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করুন। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিন, কথা বলার অধিকার ফিরিয়ে দিন। দুর্নীতির কবর রচনা করে যোগ্যতার ভিত্তিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করুন।

পঞ্চমতঃ রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাঁড়াতে দিন প্লিজ। এগুলো না দাঁড়ালে আমরা কোনোদিন দাঁড়াতে পারবো না, কিছু মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে আর কিছু ব্রিজ-কালভার্ট করে প্রকৃত উন্নয়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। বিআরটিএ’কে শক্তিশালী এবং দুর্নীতিমুক্ত করুন। ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস এবং রুট পারমিটের ব্যাপারগুলোর ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমান ছাড় দেয়া যাবে না। ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান, দুর্নীতিবাজ ট্রাফিক পুলিশদের ক্লোজ করে সৎ লোকদের নিয়োজিত করুন এবং ট্রাফিক পুলিশদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হলেই তড়িৎ ব্যবস্থা নিন। চালক এবং সাধারণ জনগণ আপনারা নিজেরা কোনো অবস্থাতেই ঘুষ দিবেন না বরং যে ঘুষ নিতে আসবে তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিন।

sentbe-adষষ্ঠতঃ সবচেয়ে বেশি যাদের সমস্যা তারা হচ্ছি আমরা নিজেরাই। আইন মানতে চাইনা বরং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ক্ষমতা ফলানোর চেষ্টা করি, বিপদে পরলে পুলিশকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। আমাদের অসৎ মানসিকতা, অসচেতনতা, বারংবার আইন ভঙ্গ করা আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে। বিচারপতি, সচিব, এডিশনাল আইজি, নির্বাচন কমিশনার, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মানুষ কেউই তো আইন মানছেন না যা প্রমাণিত কাজেই বড় বড় কথা বাদ দিয়ে আসুন আমরা সতর্ক হই, দেশটাতো আমাদের সবার। আসুন না প্লিজ একটু মানুষ হই, মানবিক হই আর তাহলেই তো দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। নিজেরা আইন মানুন, অন্যদের আইন মানতে সহায়তা করুন এবং আইন ভঙ্গকারীকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দিন আর দেখেন কিভাবে সমস্যাগুলো কমে যায়। আসুন, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নয় বরং সচেতনতার সাথে যার যার স্ব স্ব দায়িত্ব সততা আর নিষ্ঠার সাথে পালন করি।

সপ্তমতঃ সরকারের কাছে ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবি চাকুরীতে কোটা সংস্কার। যৌক্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত এই দাবি মেনে নিয়ে আপনারা নিজেদেরকে জনগণের কাছে যোগ্য হিসেবে পেশ করুন প্লিজ। আপনাদের নৈতিক ভিত্তি শক্ত নয় তাইতো কিছুদিন পর পর জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে আর আপনারা বার বার রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে, কূটকৌশল দিয়ে দাবিদাওয়া মেনে না নিয়ে বরং বল প্রয়োগ আর মিথ্যাচারকে অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করছেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে চাইলে জনগণের পালস বুঝুন। বল আপনাদের কোর্টে, চাইলে নায়ক হতে পারেন আর না চাইলে নির্বুদ্ধিতার প্রমান দিয়ে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হোন। একবার যেহেতু সবাই প্রতিবাদ করতে শিখেই গেছে তখন আর বল প্রয়োগ করে এটা থামানোর শক্তি আপনাদের নেই। যত দ্রুত বুঝবেন, ততই কল্যাণ দেশটার। আর বিরোধী পক্ষ আপনারা কতটা ভালো তাওতো আমরা জানি, কাজেই দয়া করে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনগুলোকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে আসবেন না প্লিজ।

অষ্টমতঃ দেশটা আপনার, আমার, আমাদের সকলের। আসুন না, দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাই। কেবলমাত্র অভিযোগ না দিয়ে বরং সমস্যাগুলো সমাধানে সবাই দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাই। এই দেশটাতে সব আছে ভাই, কেবল একটা যোগ্য নেতৃত্ব, সচেতনতা এবং যার যার অবস্থান থেকে সততা আর নিষ্ঠার সাথে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করলেই আমরা এগিয়ে যাবো ইনশা আল্লাহ। পরিশেষে সেই প্রিয় সঙ্গীতের লাইন দুটো মনে করিয়ে দেয়, “একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার”।

(আমার লেখায় কেউ কোনোভাবে কষ্ট পেলে অনুগ্রহ করে নিজ গুণে ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন, দেশমাতৃকাকে প্রকৃতভাবে ভালোবেসে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।)

লেখক: এম এল রায়হান
গবেষক, কিয়োটো ইউনিভার্সিটি, জাপান
আগস্ট ৩, ২০১৮