দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সীমিতভাবে চালু করা হয়েছে গণপরিবহন। তবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৬০ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতে এক সিটে যাত্রী বসিয়ে আরেক সিট ফাঁকা রাখার কারণ দেখিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে দেখা যাচ্ছে, বাসভাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিমানভাড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এ নিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতি, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
রোববার (৩১ মে) সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাস বা মিনিবাস চলাচলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ভাড়ার (যাত্রীপ্রতি কিলোমিটার সর্বোচ্চ ১.৪২ টাকা) ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। এছাড়া একজন যাত্রীকে বাস বা মিনিবাসের পাশাপাশি দুইটি আসনের একটি আসনে বসিয়ে অপর আসনটি অবশ্যই ফাঁকা রাখতে বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটের বাসভাড়া প্রায় বিমান ভাড়ার কাছাকাছি। অথচ বাসের মতো বিমানেও ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ যাত্রী বহন করা হচ্ছে।
নতুন সিদ্ধান্তের ফলে দেশের আন্তঃনগর বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটের ভাড়া দাঁড়াচ্ছে সর্বোচ্চ ২২০০ টাকা। অথচ ১ জুন থেকে সর্বনিম্ন ২৫০০ টাকায় ঢাকা থেকে বিমানে চড়ে চট্টগ্রামে যেতে পারবেন যাত্রীরা।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও এয়ারলাইন্সগুলোর সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইটগুলো চলবে এক সিটে যাত্রী ও এক সিট ফাঁকা রেখে অর্থাৎ ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে।
১ জুন থেকে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে ভাড়া ঘোষণা করেছে এয়ারলাইন্সগুলো। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-সৈয়দপুর রুটের সর্বনিম্ন ওয়ানওয়ে টিকেট ধরা হয়েছে ৩৩০০ টাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ৩১০০ এবং ঢাকা-সিলেট রুটের ৩১০০ টাকা। ইউএস-বাংলার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুর রুটে সর্বনিম্ন ওয়ানওয়ে ভাড়া ২৯৯৯ টাকা এবং সিলেট রুটে ৩২০০ টাকা। নভোএয়ারের ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটে সর্বনিম্ন ওয়ানওয়ে ভাড়া ২৫০০ টাকা এবং সিলেট ও সৈয়দপুর রুটে ৩২০০ টাকা। প্লেনের যাত্রী সংখ্যা কমলেও অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া প্রায় আগের মতোই থাকছে।
অথচ যাত্রী সংখ্যা কমানোর অজুহাত দেখিয়ে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৬০ শতাংশ। এই সিদ্ধান্ত জানানোর পর বাস কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটে গ্রিন লাইনের এসি ডাবল ডেকারের ভাড়া ১৮০০ টাকা, দেশ ট্রাভেলসের ১৬০০ টাকা (এসি), সেন্টমার্টিন পরিবহনের ১৩০০ টাকা (এসি, ইকোনমি), সিল্কলাইনের ১৭০০ টাকা (এসি), গ্রিন সেন্টমার্টিন এক্সপ্রেসের ভাড়া ২০০০ টাকা (এসি) ও ২০০০ টাকা ধরে টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। এছাড়া গ্রিন লাইনে সিলেটের বাসভাড়া ২০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যরা এখনো ভাড়া নির্ধারণ করেনি।
যাত্রীদের কাছ থেকে বাসের সার্ভিস দিয়ে বিমানভাড়ার কাছাকাছি টাকা নেয়ার বিষয়টির নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে যাত্রীদের সংগঠনগুলো। এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ লকডাউনে কর্ম হারিয়ে নিদারুণ আর্থিক সংকটে থাকা জনগণের ওপর বর্ধিত ভাড়া চাপিয়ে দেয়া হলে তা ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ’- এ পরিণত হবে। করোনা মহামারির এই দুর্যোগে গণপরিবহন বিশেষ করে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি না করে জ্বালানি তেলের দাম কমানো ও পরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানাই আমরা।
তিনি আরও বলেন, যে কোনো সংকটে বা অজুহাতে দেশে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালে তা স্বাভাবিক সময়ে কমানোর কোনো নজির নেই। দেশের ইতিহাসে দীর্ঘ ছুটিতে থাকা সাধারণ মানুষ এখন এক ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পতিত, তাই অর্ধেক যাত্রী নিয়েও যেন গণপরিবহনগুলো বিদ্যমান হারে ভাড়া আদায় করে পরিবহন সেবা চালু রাখতে পারে, তার জন্য গণপরিবহন চালুর আগেই জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দেয়া উচিৎ।
যাত্রী অধিকার আন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক অন্তু মুজাহিদ বলেন, আগে নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়লেও এ পর্যন্ত কমানোর নজির নেই। মহামারির মধ্যে এই ভাড়া বৃদ্ধি করে যাত্রীদের সঙ্গে মহাঅন্যায় করা হচ্ছে। অনতিবিলম্বে গণপরিবহনের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করা, প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি যুক্ত করা, তেলের দাম কম রাখা, পরিবহনের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে সেনা নিয়ন্ত্রণে গণপরিবহন পরিচালনা করা উচিৎ বলে আমরা মনে করি।
বাসভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। সেখানে জোটের নেতারা বলেন, সরকার বলেছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলবে অর্থাৎ ৫০ শতাংশ সিট খালি রাখবে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে সরকার, প্রশাসন এবং বিআরটিএ ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচলে কিংবা লাইসেন্সবিহীন চালকের গাড়ি চালানো বন্ধ করতে পারেনি। সেখানে কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালাবে তা বোধগম্য নয়। তদুপরি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে একতরফা মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যা কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়াসহ করোনায় বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বাড়তি চাপ তৈরি করবে।