Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মহাসড়ক যেন ছেঁড়া কাঁথা

fad
ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়ক যেন ভোগান্তির অপর নাম। রাস্তার অনেক অংশই এরকম খানাখন্দে ভরা। যোগাযোগমন্ত্রীর আশ্বাসের পর ইট, বালু ফেলে ঈদে যান চলাচল উপযোগী করার চেষ্টা চলছে। গতকাল মহাসড়কের ভালুকা পৌরসভা এলাকা থেকে ছবিটি তোলা l সাজিদ হোসেন, প্রথম আলো।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যেন ছেঁড়া কাঁথা। একদিকে নতুন নতুন গর্ত হচ্ছে, আরেক দিকে চলছে মেরামত। পাথর-খোয়া-বালু আর পিচের এই মেরামত যেন ছেঁড়া কাঁথা তালি দেওয়ার মতোই। তবে জোড়াতালির অসমান মেরামতের স্থানে চাকা পড়লেই লাফিয়ে উঠছে গাড়ি। ঝাঁকুনি লাগছে যাত্রীর শরীরে।
ঈদ ঘনিয়ে আসায় দেশের এই প্রধান মহাসড়ককে চলাচল উপযোগী করার কাজ চলছে। তবে মহাসড়কের সীতাকুণ্ড অংশ এতই বেহাল যে তা জোড়াতালি দিয়েও চলাচল উপযোগী করা যাচ্ছে না। মহাসড়কের এই অংশের প্রায় এক কিলোমিটার এখনো ঈদযাত্রা মাটি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। খারাপ রাস্তায় লাগা যানজট ছড়িয়ে পড়তে পারে মহাসড়কজুড়ে।
গতকাল রোববারও কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী পর্যন্ত মহাসড়কের স্থানে স্থানে মেরামত করতে দেখা গেছে। তবে খোদ মেরামতকারীদেরই আশঙ্কা, বৃষ্টি হলে সব মাটি হয়ে যাবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সূত্র জানায়, ২০১০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর এই সড়কের আর বড় ধরনের মেরামত হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী, ঠিকাদার বিদ্যমান মহাসড়ক চালু রাখার জন্য যে মেরামত করার দরকার তা করার কথা। কিন্তু তাঁরা সেটা করেননি। ২০১১ সালে মহাসড়কের খানাখন্দ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ার পর প্রায় ৬০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করে তা মেরামত করে সওজ। এবারের বর্ষা আবারও ২০১১ সালের অবস্থায় নিয়ে যায় মহাসড়কটিকে। এবারও ঠিকাদারেরা মেরামত করেননি, চুক্তি মানেননি। কিন্তু দেশের প্রধান দুই শহর এবং সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সচল রাখতে সওজ নিজস্ব অর্থায়নে তা মেরামত শুরু করে।
চার লেনের কাজের সঙ্গে বিদ্যমান সড়কে পানি জমতে না দেওয়ার কাজও করার কথা ছিল ঠিকাদারের। এটাকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয় ‘প্রোফাইল কারেকশন’। মহাসড়কের যে অংশে চীনা কোম্পানি সিনো হাইড্রো কাজ করছে, সে অংশে তারা তা করেনি। দেশীয় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেজা কনস্ট্রাকশন ও তাহের ব্রাদার্স এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও কথা রেখেছে।
চার লেনের কাজ চলার কারণে বিদ্যমান সড়কের শোল্ডার (দুই পাশের বাড়তি অংশ) ভেঙে গেছে। ফলে ব্যবহার উপযোগী সড়কও কমে গেছে। এ জন্য যানজট বাড়ছে।
গতকাল ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে এই প্রতিবেদক ও ফটোসাংবাদিক হাসান রাজাকে বহনকারী গাড়িটি যখন ছাড়ে, তখন ঘড়িতে দুপুর ১২টা। ঢাকার যানজট আর শিমরাইল এলাকার আট লেনের ধকল সামলে গাড়িটা কাঁচপুর সেতু পার হতে দেড়টা বেজে যায়। মেঘনা-গোমতী আর মেঘনা সেতু পার হতে কিছুটা তন্দ্রা এসে পড়ে। কিন্তু দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজার পার হওয়ার সময় ঝাঁকিতে সেই তন্দ্রা ভেঙে যায়। এরপর আর দুই চোখ এক হয়নি। টানা বর্ষণ আর মেরামতের অভাবে সৃষ্ট গর্তগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সড়ক তাতে ন্যূনতম মসৃণতা পায়নি। এই চিত্র চান্দিনার মাদাইয়াসহ পুরো পথেই।
বেলা আড়াইটা। কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস পার হচ্ছিল আমাদের গাড়ি। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। গাড়ি থেমে গেছে। নেমে দেখা গেল, সড়কের গর্ত ভরাটে ব্যস্ত সওজের কর্মীরা। দুটি গাড়িতে ইট-পাথরের খোয়া ও পিচ মিশিয়ে রাস্তায় ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে বালু দিয়ে সমান করে দিচ্ছেন শ্রমিকেরা।
সেখানে কথা হয় সওজের কর্মকর্তা আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, গর্ত এবং নিচু জায়গা যেখানেই পাচ্ছেন সেখানেই তা ভরাট করছেন। সময় বেশি নেই। তাই শেষ করার তাড়া আছে।
এই মেরামত তো আগেও হয়েছে, থাকেনি। এবারেরটা কত দিন চলবে—এমন প্রশ্নের জবাবে একরাশ উদ্বেগ মুখে ভাসিয়ে এই কর্মকর্তা বললেন, ‘বৃষ্টি হলেই বিপদ। ভারী বৃষ্টি না হলে ঈদটা অন্তত সুন্দরভাবে পার করে দেওয়া যাবে।’
ময়নামতি সেনানিবাস থেকে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার পর্যন্ত এভাবে স্থানে স্থানে মেরামতের চিহ্ন দেখা গেল। মিয়াবাজার থেকে গাড়ি ছাড়ার পর চালক রাজু বলতে থাকেন, ‘স্যার, গাড়ি তো খালি বাঁয়ে টানে। স্টিয়ারিং ধরে রাখা কঠিন। একটু এদিক-ওদিক হলেই দুর্ঘটনা।’
রাস্তায় তাকিয়ে দেখি, তিন-চার স্তরের ঢেউ। বিভিন্ন সময় জোড়াতালির মেরামত ভারী যানবাহনের চাকার ঘর্ষণে এদিক-সেদিক সরে গেছে। তাতে রাস্তায় এই উঁচু-নিচু ঢেউ তৈরি হয়েছে। ডান-বাম করতে গেলেই চাকা হড়কে যায়। ফেনীর ধুমঘাট পর্যন্ত কমবেশি এই চিত্র চোখে পড়ল।
ঢেউ খেলানো এই রাস্তা সম্পর্কে মিয়াবাজার এলাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক আবদুল কুদ্দুস বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এই অবস্থা। পিচমাখা পাথর ফেলে যাওয়ার পর গাড়ির চাপে সেগুলো সরে যায়। এখন গাড়ি চালানোই কঠিন।
ফেনী পার হয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রবেশ করতেই বারৈয়ারহাট বাজারে আরেক দফা ভাঙা সড়ক। সেখানে গভীর গর্ত নেই। কিন্তু রাস্তার ছাল-বাকল উঠে গেছে। চলতে চলতে একসময় এসে গাড়ি পৌঁছায় সীতাকুণ্ডের ছোট দারোগারহাটে। মহাসড়কের যেসব স্থানে বাজার আছে সেখানে পিচের বদলে সিমেন্টের রাস্তা করা হয়েছে। ছোট দারোগারহাটে বিদ্যমান দুই লেন সড়কের এক লেনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরেক লেনের মাঝখানে নালার মতো। পিচঢালা রাস্তারও ছাল-বাকল নেই।
সীতাকুণ্ডের পৌর সদর বাইপাসে আসতে আসতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সেখানে এসে দেখা যায়, পুরোনো বাইপাসের প্রায় আধা কিলোমিটারে কোনো পিচ নেই। ১০০ মিটার এলাকা পুরো মহাসড়কের মধ্যেই সবচেয়ে ভয়াবহ। আস্ত আস্ত ইট বিছিয়ে বালু দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন সওজের কর্মীরা। দিনভর কাজ চলছিল। তাই সড়কের মাঝখানেই বালুর স্তূপ পড়ে আছে। দ্রুতগতির গাড়িগুলো এখানে এসেই গতি হারিয়ে ফেলছে। চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য যে জিকজ্যাক পরীক্ষা দিতে হয়, মনে হলো তেমন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন চালক। স্থানীয় লোকজন জানান, সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে এই স্থানটিতে হাঁটুসমান পানি জমেছিল। তখন পরিবহন মালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
স্থানীয় দোকানি আবুল কাসেম বলেন, এই স্থানটির অবস্থা এক মাস ধরেই এমন। সকালে মেরামত হয়, রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়। কত গাড়ি যে ফেঁসে গেছে আর তাতে করে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে, এর কোনো হিসাব নেই।
এখানে ‘এআরসি’ নামের একটি কোম্পানির ইট বসানো হয়েছে। ওই ইটভাটাকে গত ২৯ জানুয়ারি ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। স্থানীয় লোকজনের দাবি, লোনা মাটি দিয়ে তৈরি এসব ইটের মান ঠিক নেই।
এই পথে যানজট হলে সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া পুরোনো ঢাকা ট্রাংক রোড ধরে যানবাহন চলাচল করত। কিন্তু ওই সড়কটিতেও বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। বৃষ্টি হলে গর্তে পানি জমে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
সীতাকুণ্ডের বেহাল অংশ দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাকচালক মিন্টু মিয়া বলেন, ‘ভাই, ছবি তুইল্ল্যা কোনো লাভ নাই। এই রাস্তার অবস্থা যা আছে তাই থাকব। আমরাও অভ্যস্ত হইয়া গেছি।’
স্থানীয় লোকজন জানান, মহাসড়কের মাদামবিবিরহাটে ও জলিলগেটেও সড়কের এক পাশে ছাল-বাকল উঠে গেছে। বিএমএ গেটে সিমেন্টের ঢালাই হলেও এক পাশ বন্ধ, ঈদের আগে খোলা হচ্ছে না বলে জানা গেছে। এসব স্থানে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা।
সীতাকুণ্ড সদর থেকে ভাটিয়ারী আসার পরই মাগরিবের আজান পড়ে। সবাই ঘরে ফেরার জন্য ছুটছে। আমরা ইফতারের জন্য জায়গা খুঁজছি। কিন্তু দূরপাল্লার পরিবহনগুলো তো থামলে চলবে না। সদ্য মেরামত করা পথ মাড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর সংগ্রাম করছে তারা। চাকা আর রাস্তার ঘর্ষণের মড়মড় শব্দের মধ্যেই হঠাৎ আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে তাকিয়ে কালো মেঘ দেখেই সওজের সেই আশরাফুজ্জামানের কথা মনে পড়ল, ‘বৃষ্টি হলে বিপদ হয়ে যাবে।’
ইফতারের পরে ভাটিয়ারী এলাকাতে হালকা বর্ষণ শুরু হয়। পথে পথে ইট-বালু-খোয়া নিয়ে যুদ্ধ করছেন সওজের যে কর্মীরা, তাঁদের পরিশ্রম বৃথা যাবে না তো!
১৩ জুলাই যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সীতাকুণ্ডে মহাসড়কের খানাখন্দ পরিদর্শন করে ২০ জুলাইয়ের (গতকাল) মধ্যে তা সংস্কারের নির্দেশ দেন। গতকালের মধ্যে সে কাজ শেষ না হলেও সড়কের অনেক অংশই মেরামত হয়েছে।
কাগজে-কলমের হিসাবে চার লেনের কাজ হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ১৯২ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার পিচঢালা হয়ে গেছে। কিন্তু পিচঢালা এই নতুন সড়ক এখনো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ এই ৭৫ কিলোমিটার একটানা নয়, ভাগে ভাগে হয়েছে।
সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পিচঢালা অংশগুলো এখনই ব্যবহার করতে দিতে চাইছেন না ঠিকাদারেরা। বিশেষ করে চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রোর অংশটুকুর প্রবেশমুখে মাটির ঢিবি দিয়ে আটকে দিয়েছে। কারণ তাদের ধারণা, এই সড়ক বুঝিয়ে দিতে আরও অন্তত দেড়-দুই বছর লাগবে। এখনই নতুন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলতে দেওয়া হলে এরই মধ্যে ভেঙে যেতে পারে। তখন মেরামত কিংবা ক্ষতিপূরণের দায় আসবে। তবে সীতাকুণ্ড সদর এলাকা, মিরসরাই ও কুমিল্লার কিছু কিছু অংশে যেখানে বিদ্যমান মহাসড়ক খুবই বেহাল হয়ে পড়েছে, সেখানে সীমিত আকারে নতুন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে।
রাত ১০টায় ভাটিয়ারী থেকে রওনা করে আমরা চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছালাম রাত সাড়ে ১১টায়। রাস্তার এই অংশটি মোটামুটি ভালো। আগামীকাল (আজ) আবার এ পথেই ঢাকা ফিরব আমরা।