Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

শাবাশ গাজাবাসী, শাবাশ ফিলিস্তিন!

ইতিহাসে বারবার আফগানিস্তানের উপত্যকা, মালভূমি আর গিরিপথগুলো সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের ‘গোরস্তান’ বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ঠান্ডা যুদ্ধে মুজাহেদিন প্রতিরোধে সেখান থেকে পতনোন্মুখ সোভিয়েত সাম্রাজ্যের প্রত্যাহার ঘটে। কিন্তু তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুতেই আবার সেখানে ঘটেছিল পাল্টা আধিপত্যবাদী পরাশক্তির হস্তক্ষেপ। মুজাহেদিন আল কায়দা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধের নামে সেখানে কায়েম হয়েছিল মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের দখল। কিন্তু একযুগ ধরে পাশ্চাত্য শক্তিজোটবান্ধব অভিজন শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা ও পাশ্চাত্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনুগত সৈন্যদলের অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের তালেবান মুজাহেদিনদের চোরাগোপ্তা প্রতিরোধ কাবু হয়নি। তাই এবছর সেখান থেকে মার্কিন-ন্যাটো জোটের সৈন্য প্রত্যাহারের পর ইউরেশিয়ায় মার্কিন পরাশক্তি নির্ধারিত দক্ষিণের প্রবেশদ্বার আফগানিস্তান কতটা মার্কিন করায়ত্তে থাকে, সেটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

_76789236_76786842 এরই মধ্যে এ বছরই যে প্রতিরোধ যুদ্ধটি নির্বিচার গণহত্যা, নাগরিক ধ্বংসস্তূপ আর অগ্নিবর্ষী বিমান-কামান-নৌ হামলা ও সাঁজোয়া বাহিনীর অভিযান সহ্য করে অপত্যবিয়োগ, অনিদ্রা, অনাহার, অর্ধাহার, গণহারে বাস্তুচ্যুতির মধ্যে জাতীয় ঐক্য, স্বাজাত্যাভিমান ও মনোবলের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছে, অসম যুদ্ধে গুপ্ত প্রতিরোধের রকেট বর্ষণ অব্যাহত রেখে ‘নৈতিক বিজয়’ অর্জন করে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে, সেটি গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের জীবনপণ লড়াই। শাবাশ গাজাবাসী! শাবাশ ফিলিস্তিন!

chardike-ad

গাজায় নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি হামাসকে শায়েস্তা করে ২০০৮ সালে জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের সমঝোতাকামী ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদদের দিয়ে একটি পুতুল সরকার খাড়া করে অনুগত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের নামমাত্র প্রতিষ্ঠার ফন্দি এঁটেছিল ইসরাইল। তখন গাজায় বিমান হামলা ও সাঁজোয়া অভিযান চালিয়ে ৩ হাজার ৪০৮টি লক্ষ্যবস্তুকে বোমা বা কামানের গোলায় গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ইসরাইল, অভিযানে ইসরাইল নিযুক্ত করেছিল এফ-১৬ বোমারু বিমান, মেশিনগানবাহী উড়োজাহাজ, ১৫৫ মিলিমিটার কামানের গোলাবারুদ, মারকাভা সাঁজোয়া বাহিনী ও জঙ্গি নৌযান। হামাসের আত্মরক্ষা যোদ্ধা ইজ্জেদিন কাসাম ব্রিগেডের হাতে ছিল শুধু ঘরে তৈরি কিছু কাসাম রকেট, মর্টার আর হাতবোমা। ইসরাইলের লোকক্ষয় হয়েছিল মাত্র ১৩, যার মধ্যে ১০ জন ছিল সৈন্য, তিনজন বেসামরিক লোক। ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৬৮, যার মধ্যে ৯২৬ জনই ছিল বেসামরিক গাজাবাসী। তখন থেকেই সমুদ্রপথ, স্থলপথ ও আকাশপথে গাজার সামরিক অবরোধ অদ্যাবধি বজায় রেখেছে ইসরাইল, মিসরের দিকে গাজার বহির্গমনের একমাত্র পথ রাফা ক্রসিং ও ইসরাইলের সঙ্গে যোগসাজশ করে মিসর কড়া পাহারায়ও লোহার পাতের বেষ্টনী দিয়ে অবরুদ্ধ রেখেছে। কোনো নির্মাণ সামগ্রী বা রাসায়নিক সামগ্রীর আমদানি হতে পারেনি গাজায়, শুধু সীমিত পরিমাণে নিত্যব্যবহার্য পণ্য খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধের সরবরাহ হয়েছে ইসরাইলি বা মিসরীয় সামরিক তত্ত্বাবধানে; জাতিসংঘ মিশন সহায়তা দিয়েছে কিছু স্বাস্থ্যসেবা ও শিশুশিক্ষা কেন্দ্র পরিচালনায়। কর্মসংস্থান বঞ্চিত মানবেতর জীবনযাপন করেছে গাজাবাসী বছরের পর বছর ধরে; কিন্তু উদ্যম হারায়নি। সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মিসরের সিনাই মরুবাসীর সহযোগিতায় গড়ে তুলেছে বহির্বাণিজ্যের বিকল্প পথ, এমনকি ইসরাইলের অভ্যন্তরের গোপন প্রবেশপথের বিস্তার ঘটিয়েছে গিরিগুহা খুঁড়ে। সমুদ্রতীরের বেলাভূমিতে ইসরাইলি জঙ্গি নৌ অবরোধে নিরাপত্তাহীন হয়ে এমনকি সমুদ্রে মাছ ধরার অধিকার বঞ্চিত হয়ে গাজার অর্থনীতি, উৎপাদন ক্ষমতা রহিত হয়েছে; কিন্তু উদ্ভাবনী মেধার বদৌলতে ওই বেলাভূমি অবলম্বন করেই বিস্তৃত করেছে আত্মরক্ষার যুদ্ধকৌশল, আয়ত্ত করতে শুরু করেছে রুশ দেশীয় গ্রাড মিসাইল এবং পারস্যদেশীয় ফাজর-৫ রকেটের প্রযুক্তির রূপান্তর।

২০১২ সালে আবার গাজা আক্রমণ করেছে ইসরাইল, ১ হাজার ৫০০ লক্ষ্যবস্তুকে বোমা বা কামানের গুলিতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। আক্রমণের প্রতিরোধে প্রাণ হারিয়েছিল ১৩৩ গাজাবাসী, যার মধ্যে ৫৩ জন ছিল বেসামরিক ব্যক্তি। ইসরাইলের লোকক্ষয় হয়েছিল মাত্র ৬ জন, যার মধ্যে চারজন ছিল বেসামরিক ব্যক্তি। আত্মরক্ষায় ২০০৮ সালে ৭৫০টি হাতুড়ে রকেট নিক্ষেপ করে শক্তিধর ইসরাইলকে পরোয়া না করার মনোবল প্রদর্শন করেছিল হামাস। ২০১২ সালে কিছুটা উন্নতমানের ১ হাজার ৪৫৬টি রকেট ইসরাইলি ভূখন্ডে নিক্ষেপ করে প্রতিরোধের ঝান্ডা উড্ডীন রেখেছিল হামাস। এবার হামাসকে ‘নিরস্ত্র’ করা এবং গাজাবাসীকে সন্ত্রাসকাতর ও পদানত করার লক্ষ্যে ইসরাইল ৮ জুলাই থেকে শুরু করেছিল মাসব্যাপী বোমারু বিমান হামলা, উপকূলে নৌবাহিনীর মিসাইল হামলা, আর জনপদে সরাসরি সাঁজোয়া গাড়ির দখলদারি ও কামানের গোলাবর্ষণ। এবার হামাস ৩ হাজার রকেট ছুড়ে এবং তেলআবিব বিমানবন্দরের কাছে রকেটবোমা ছোড়ার সক্ষমতা দেখিয়ে মূলত আবারও ইসরাইলি দাপট অগ্রাহ্য করার মনোবল প্রদর্শন করেছে। কার্যত এসব রকেটে ইসরাইলের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে যৎসামান্য, তবে ইসরাইলি নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ বিলক্ষণ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ইসরাইলের হিসাবমতে, হামাসের রকেট হামলার ভয়ে মধ্য ইসরাইলের ৭০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যায় এবং সমগ্র ইসরাইলের অর্থনৈতিক উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ শতাংশ হ্রাস পায়। তবে যুদ্ধাভিযানের মধ্যেই ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রসর প্রযুক্তি ও ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অর্থসাহায্য লাভ করে ইসরাইল রকেট বিধ্বংসী ‘লৌহগম্বুজ’ স্থাপন করে অধিকাংশ হামাস রকেট গতিপথেই বিস্ফোরিত করেছে। এবার রকেটের আঘাতে কিংবা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘর্ষে ইসরাইলের বেসামরিক লোকক্ষয় হয়েছে মাত্র তিনজন, তবে গাজায় যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিহত সৈন্যসংখ্যা এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ জনে। তাতে ইসরাইলি জনগণের নিরাপত্তাবোধে আরও চিড় ধরেছে। হামাসের ৩ হাজার রকেটের বিপরীতে ইসরাইলি সৈন্যরা ছুড়েছে ৫০ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র। ইসরাইলের বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মোশে ইয়ালুন ২০০২ সালে ছিলেন ইসরাইলের সামরিক বাহিনী প্রধান। তিনি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন এ বলে যে, ফিলিস্তিনিদের চেতনার অন্তস্তলে একথা খোদাই করে দিতে হবে যে, তারা একটা পরাজিত জনগোষ্ঠী। এবারের সর্বাত্মক আক্রমণে গাজাবাসীর নরকযন্ত্রণা দিয়েও সে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি ইসরাইলি সমরশক্তি। অসম যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের বীভৎসতায় সারা বিশ্বের মানবতাবাদী বিবেক জাগ্রত হয়ে ধিক্কার তুলেছে দেশে দেশে; মার্কিন-ন্যাটো জোটভুক্ত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো সরকারি পর্যায়ে ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে গেলেও গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ধিক্কারের ঝড় উঠেছে ইউরোপ ও আমেরিকার নগরে-বন্দরে। প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামী সহযোগিতার সব দেশ; বিশেষ করে তুরস্ক, কাতার ও ইরান শুধু কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে নয়, নিয়মিত-অনিয়মিত সব রকম সম্ভাব্য প্রক্রিয়ায় গাজাবাসীর জন্য সাহায্য ও প্রতিরোধ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার সব সরকার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। মিসরের স্বৈরশাসক সিসি সমর্থক ও হামাসবিদ্বেষী সৌদি বাদশা আবদুল্লাহ নিজেও গাজায় ইসরাইলের ভয়াবহ ও নৃশংস হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ এবং ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করে ‘বিশ্ব সমাজের নীরবতার’ ফলে শান্তিবিরোধী প্রজন্ম গড়ে উঠবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন। আর ইসরাইলি হিসাবমতেই ফুটে উঠেছে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের চিত্র।

গাজায় ইসরাইলি হামলার ২৯ দিনের মাথায় যখন নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল ও হামাস সম্মত হয়ে ইসরাইলি বাহিনী গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিল, তখন ইসরাইলি পত্রিকা হারেজের প্রকাশিত তথ্যমতে, ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৬৭, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘরগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও মৃতদেহ উদ্ধারের সম্ভাবনা। নিহতদের শতকরা ৮০ ভাগ বেসামরিক ব্যক্তি। পঙ্গু ও আহতের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। ইউনিসেফের হিসাবমতে, বেসামরিক মৃত্যুর শতকরা ৩১ ভাগ শিশু, তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ ১২ বছরেরও কম বয়সী ২৫১ ছেলে ও ১৫৭ মেয়ে। ৩ লাখ ৭৩ হাজার শিশু ক্রমাগত গোলাগুলির আওয়াজে ও ঘরছাড়া অবস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেছে। গাজার ৫ হাজার ২৩৮টি ঘরবাড়ি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০ হাজার ৫০টি বাড়ি। হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা ও পার্লামেন্ট নেতাদের ১২টি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে পুরো গাজাবাসী। পাওয়ার প্লান্ট, ইন্টারনেট ভবন ও টেলিফোন টাওয়ারে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানায় ৮০ শতাংশ টেলিফোন নেটওয়ার্ক স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে গেছে। এতে গাজার জনগণ মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক বা রেডিও-টেলিভিশনের ফ্রিকোয়েন্সি থেকেও বঞ্চিত।

ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, তারা এবারের গাজা অভিযানে ৮১ হাজার ২০১ রিজার্ভ সৈন্য তলব করেছিল; ৪ হাজার ৭০২ সংখ্যক লক্ষ্যবস্তুতে তারা আঘাত হেনেছে। ইসরাইল বিমান হামলায় ৬ হাজার ৩১৮টি ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, নৌবাহিনী ১৩ হাজার ৮৬৬টি ও ট্যাঙ্ক কামান ৩০ হাজার ৫৮১টি গোলা নিক্ষেপ করেছে। ৩২টি টানেল বা সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস করা হয়েছে। ইসরাইলের অভ্যন্তরে তাদের অপর প্রান্তও ধ্বংস করা হবে। মিশন সমাপ্ত। আরবি টেলিভিশন আল আলম বলছে, ইহুদিবাদীরা কিছু সুড়ঙ্গ দখল করতে পেরেছে, সারা গাজা এলাকা চষে বেড়াতে পারেনি। হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতার আস্তানাগুলো এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে।

এভাবে প্রতিরোধের লৌহকঠিন মনোবলের গম্বুজ রচনা করে উদ্ভাবনী কৌশলের বর্ম দিয়ে গাজাবাসী ফিলিস্তিনিরা বাংলাদেশসহ দুনিয়ার উন্নয়নশীল নানা দেশের মানুষ যারা বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ফাঁসে শিখন্ডীর দুঃশাসন ও বঞ্চনার শিকার, তাদের জন্য একটি প্রেরণাময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেল বৈকি।

লেখক-জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। আলোকিত বাংলাদেশ।