এখন যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সড়কগুলো। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে, আর প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই ভয়াবহ চিত্র শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়—এটা হাজারো পরিবারে বয়ে আনছে কান্না, শোক আর নিঃসঙ্গতা।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ এর বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, আর আহত হন লক্ষাধিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো—চলাচলের অনিরাপদ অবস্থা, বেপরোয়া চালক, দুর্বল সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকর ট্রাফিক আইন প্রয়োগের অভাব।
ঈদ-উল-আজহা—ত্যাগ ও পারিবারিক বন্ধনের উৎসব। কিন্তু প্রতি বছর এই আনন্দ ছাপিয়ে যায় একটি ভয়াবহ বাস্তবতা: সড়কে অপ্রয়োজনীয় প্রাণহানি।
এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। এক কিশোর তার বাবার সঙ্গে কোরবানির গরু নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিল। পথে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা প্রাণ হারান। ছেলেটি নিজ হাতে বাবাকে দাফন করে আবার রওনা দেয় ঢাকার পথে—গরু বিক্রি করতে। এই গল্প শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং গোটা সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে শোক পালনের অধিকারও বিলাসিতা হয়ে উঠেছে।
সড়কে ঈদের রক্তাক্ত চিত্র:
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ঈদ-উল-আজহায় ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯০ জন নিহত, ১,১৮২ জন আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালে একই সময়ে দুর্ঘটনা ছিল ৩০৯টি। যাতে মৃত্যু হয়েছে ৩৩৬ জনের এবং আহত হয়েছেন ৭৬২ জন।
অর্থাৎ, এক বছরে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২.৬৫ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ১৬.০৭ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৫৫.১১ শতাংশ।
সড়ক মানে মৃত্যু ফাঁদ?
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। বাস, ট্রাক, সিএনজি ও মোটরসাইকেল চালকরা অনেক সময় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান, মানেন না ট্রাফিক সিগনাল বা নিয়ম। তার ওপর আছে লাইসেন্সবিহীন চালকদের দৌরাত্ম্য।
পরিবারের আহাজারি, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
একটি দুর্ঘটনা শুধু একজনের জীবন নিয়ে যায় না—ভেঙে দেয় একটি পরিবার, ধ্বংস করে ভবিষ্যৎ। পথচারী, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, এমনকি শিশুরাও এই মৃত্যুফাঁদের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ মানুষ, যারা দিনমজুরি করে জীবিকা চালান—তাদের পরিবারের একজন সদস্য হারিয়ে গেলে তা হয়ে ওঠে তাদের জন্য অভিশাপ।
সমাধান কোথায়?
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর আইন প্রয়োগ, চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, যাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ—এই পদক্ষেপগুলো জরুরি। সেইসঙ্গে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
সড়ক যেন শুধুই চলার পথ নয়, হয়ে উঠেছে মৃত্যুর রুট। এই চিত্র পাল্টাতে হলে এখনই সময় ব্যবস্থা নেওয়ার। নইলে প্রতিদিনই আমরা হারাব আরও অনেক জীবন, আর বাড়বে নিঃস্ব পরিবারের সংখ্যা।