Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জনশক্তি রপ্তানির হালচাল

manpower-exportবিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে বাংলাদেশ থেকে কর্মী না নেওয়া এবং জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি খাতকে নিরুৎসাহিত করাসহ বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে।

এ কারনে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপরও পড়েছে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব। এছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি ক্ষেত্রে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছিল তার খেসারত এখনও দিতে হচ্ছে। বিশেষ করে মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো জনশক্তি রফতানি করতে পারছে না। ফলে জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি খাত তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।

chardike-ad

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, জনশক্তি রপ্তানি কমেছে তা ঠিক নয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও জনশক্তি রপ্তানির প্রবৃদ্ধি অক্ষুন্ন ছিল। এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখনই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়ে তখন আমাদের কর্মী রপ্তানিও বাড়ে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রতি বছর যেখানে গড়ে আড়াই লাখ কর্মী রপ্তানি হতো সেখানে বর্তমানে গড়ে পাঁচ লাখ কর্মী রপ্তানি হচ্ছে।

তিনি বলেন, বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে এখন আর কোন অভিযোগ পাওয়া যায় না। পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, আগে কর্মীরা হয়রানির শিকার হতো। সেটা ভাল ছিল নাকি এখন হয়রানি হতে হচ্ছে না সেটা ভাল ? আগে বিদেশ যেতে সর্বস্ব হারাতে হতো সেটা ভাল ছিল না কি এখন প্রবাসীকল্যান ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা হয়েছে সেটা ভাল? তিনি বলেন, জনশক্তি রপ্তানি খাতে এখন শৃংখলা ফিরে এসেছে।

বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিদের মাধ্যমে কর্মী রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেনতেন ভাবে কর্মী পাঠাবে এটা কোন ভাবে মেনে নেওয়া যায় না। সাধারন মানুষকে হয়রানি থেকে প্রটেকশন দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকারের নিয়ম মেনেই তাদের কাজ করতে হবে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মালিকদের সংগঠন বায়রার এক সাবেক সভাপতি বলেন, সরকারের গোয়ার্তুমির কারনে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত জনশক্তি রপ্তানি খাত থমকে আছে। বাংলাদেশের শ্রম বাজার এখন নেপাল, ভূটান, ভারত আর পাকিস্তানের হাতে চলে যাচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারিখাতের সঙ্গে যে দূরত্ব রয়েছে তা দূর করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৭০০ কর্মী বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপÍানি হচ্ছে এমন প্রধান ২০টি দেশসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে ২৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮১ জন। এছাড়াও এসময় সরকারি ছাড়পত্র নিয়েছেন ৪২ হাজার ৪০০ জন। এরাও কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। উল্লেখিত সময় দেশে রেমিটেন্স এসেছে ৬১ হাজার ৮৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি অন্যতম মাধ্যম জনশক্তি রপ্তানি। মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে প্রচুর জনশক্তি রপ্তানি করা হতো। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খুঁজে বের করা হতো শ্রমবাজার। বাংলাদেশের জনশক্তির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতার বাজারে এখন পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

প্রবাসীকল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বড় বাজার ছিলো মধ্যপ্রাচ্য। পাশাপাশি মালয়েশিয়া, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করা হতো। এর বাইরে কয়েকটি দেশে জনশক্তির নতুন বাজার সৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু নানা কারণে পুরনো বাজারই ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে অবৈধ শ্রমিক। মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। একশ্রেণির মুনাফালোভী জনশক্তি ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী।

তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিকদের বিদেশে পাঠায়। কাজের আশায় দেশের বাইরে গিয়ে এসব শ্রমিক প্রতারিত হন। অনেকে আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খরচের টাকা তুলতে না পেরে বিদেশেই থেকে যান। ফলে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হন তারা। এই অবৈধ জনশক্তি দেশের সুনামহানি করছে। এতে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দেশগুলো। মুসলিম দেশ না হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার দখল করে নিয়েছে ভারত ও নেপাল। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন আরব দেশে নানা ধরনের অপরাধবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এদের অপরাধের দায় পড়ছে বাংলাদেশিদের ওপর। এদের কারনে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরবে মোট ৬৬ হাজার ৬জন কর্মী রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে ৭ হাজার ৮৬৯ জন, ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৩৯ জন, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৩২ জন, ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬৫৪ জন আর ২০১৪ সালের অক্টাবর পর্যন্ত ৯হাজার ২১২ জন।

একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে মোট ৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৩২জন কর্মী রপ্তানি হয়। এরমধ্যে ২০১০ সালে ২ লাখ ৩ হাজার ৩০৮ জন, ২০১১ সালে ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ জন, ২০১২ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন, ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ২৪১ জন এবং ২০১৪ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ১৯ হাজার ৩৯২ জন। আর কুয়েতে পাঁচবছরে রপ্তানি হয় মাত্র ২ হাজার ১৪৬ জন।

ওমানে একসময় বাংলাদেশী কর্মী রপ্তানি কম হলেও গত পাঁচ বছর ধরে বেড়েছে। মোট কর্মী রপ্তানি হয়েছে ৫ লাখ ৭০ হজার ৪৮২ জন। দেশটিতে ২০১০ সালে ৪২ হাজার ৬৪১ জন, ২০১১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৫ জন, ২০১২ সালে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩২৬ জন, ২০১৩ সালে ১ লাখ ৩৪ হাজার ২৮ জন এবং ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৮৮ হাজার ২২২ জন।

গত পাঁচ বছর কাতারে জনশক্তি রফতানি বড়েছে। দেশটিতে মোট কর্মী রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ৮৪৭ জন। এরমধ্যে ২০১০ সালে ১২ হাজার ৮৫ জন, ২০১১ সালে ১৩ হাজার ১১১ জন, ২০১২ সালে ২৮ হাজার ৮০১ জন, ২০১৩ সালে ৫৭ হাজার ৫৮৪ জন এবং ২০১৪ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ৬৯ হাজার ২৬৬ জন।

পাঁচ বছরে বাহরাইনে মোট একলাখ ৬০ হাজার ৮৪৭ জন কর্মী রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে ২০১০সালে ২১ হাজার ৮২৪ জন, ২০১১ সালে ১৩হাজার ৯৯৬ জন, ২০১২ সালে ২১ হাজার ৭৭৭ জন, ২০১৩ সালে ২৫ হাজার ১৫৫ জন এবং ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৯ হাজার ৫৬৪ জন।

লেবাননে মোট ৬৯ হাজার ৩৩৪ জন কর্মী রপÍানি হয়েছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে ১৭হাজার ২৬৪ জন, ২০১১ সালে ১৯ হাজার ১৬৯ জন, ২০১২ সালে ১৪ হাজার ৮৬৪ জন, ২০১৩ সালে ১৫ হাজার ৯৮ জন এবং ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৯৩৫ জন কর্মী রফতানি হয়েছে।

জর্ডানে জনশক্তি রপ্তানি গত কয়েক বছর যে হারে বাড়ছিল তা আর এখন ধরে রাখা যাচ্ছে না। পাঁচবছরে দেশটিতে মোট ৫৬ হাজার ৯৭৮ জন কর্মী রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে ২০১০ সালে ২ হাজার ২৩৫ জন, ২০১১ সালে ৪ হাজার ৩৮৭ জন, ২০১২ সালে ১১ হাজার ৭২৬ জন, ২০১৩ সালে ২১ হাজার ৩৮৩ জন এবং ২০১৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২৪৭ জন।

লিবিয়ায় দীর্ঘদিন শ্রম বাজার বন্ধ থাকার পর শুরু হলেও দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারনে বিপুল সংখ্যক কর্মীকে দেশে ফিরে আসতে হয়। দেশটিতে ২০১০ সালে ১২ হাজার ১৩২ জন, ২০১১ সালে মাত্র ৮৯ জন, ২০১২ সালে ১৪ হাজার ৯৭৮ জন কর্মী রপ্তানি হয়। ২০১৩ সালেই তা অর্ধেকে নেমে আসে। এ বছর দেশটিতে ৭ হাজার ১৭৫ জন এবং ২০১৪ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৩৩ জনে।

মালয়েশিয়া জনশক্তি রফতানির আরেকটি গুরুত্বর্পূণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখন এই দেশটিতেও জনশক্তি রফতানির বেহাল দশা। ২০০৯ সাল থেকেই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি কার্যত বন্ধ রয়েছে। কলিং ভিসায় কর্মী নেওয়া শুরু করলে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মালয়েশিয়ান সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে যেখানে যথাক্রমে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০১ জন এবং ১ লাখ ৩১ হাজার ৭৬২ জন মালয়েশিয়া গেছে সেখানে ২০১০ সালে ৯১৯ জন, ২০১১ সালে ৭৪২ জন, এবং ২০১২ সালে ৮০৪ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৮৫৩ জন এবং ২০১৪ সালে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ১৭৪ জন কর্মী রপ্তানি হয়েছে।

সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় আবারও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানির দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। তারা বাংলাদেশ থেকে ধাপে ধাপে পাঁচ লাখ লোক নিতে রাজি হয়েছে। সরকার টু সরকার ভিত্তিতে লোক নেওয়ার এই সিদ্ধান্তের কারণেই ২০১৩ সালে যেখানে কমপক্ষে দুই লাখ লোক পাঠানোর কথা সেখানে মাত্র চার হাজারের কাছাকাছি লোক পাঠানো হয়েছে।

এক সময় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক কর্মী রপ্তানি হতো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। সে সময় বায়রার তৎকালিন সভাপতি নিয়ম বহির্ভূতভাবে একক উদ্যোগে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর ফলে এ জটিলতার সৃষ্টি হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আবার কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে জি টু জি পদ্ধতিতে সীমিত আকারে জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখান থেকে দেখা যায়, জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার কারনে এর প্রভাব রেমিট্যান্স প্রবাহের উপরও পড়েছে। গত কয়েক বছর যে হারে রেমিটান্স প্রবাহের যে গতি ছিল তা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। গত পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশী কর্মীরা মোট ৬২ হাজার ৬৩৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন।

অর্থাৎ ২০১০ সালে ১১ হাজার ৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, ২০১১ সালে ১২ হাজার ১৬৮ কোটি ৯ লাখ ডলার, ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ১৬৩ কোটি ৯৯ লাখ ডলার, ২০১২ সালে ১৩ হাজার ৮৩২ কোটি ১৩ লাখ ডলার এবং ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১১ হাজার ৪৬৫ কোটি ৫৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

তথ্যসূত্রঃ রাইজিংবিডি