Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আমাদের বিজয় দিবস পাকিস্তানিরা কিভাবে দেখে?

bijoy diboshবিজয় দিবস আমাদের জন্য গভীর আনন্দের ও গর্বের, কিন্তু পাকিস্তানের কাছে তা এক মহা বিপর্যয়, এ হলো তাদের ‘নাকবা’। একটি পাকিস্তানি ওয়েব পত্রিকায় ষোলই ডিসেম্বর উপলক্ষে একটি সংক্ষিপ্ত লেখায় আমি মন্তব্য করেছিলাম, বাঙালির এই বিজয়ের সঙ্গে আপনারা যত দিন সংহতি বোধ না করবেন এবং একাত্তরের গণহত্যায় আপনাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না অর্জন করবেন, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পুরোপুরি সমঝোতা কখনোই অর্জিত হবে না। ‘আমরা দুঃখিত’ বলে শুকনো মুখে দুই কথা বললেন আর ক্ষমা হয়ে গেল, মোটেই নয়। ক্ষমা যাদের করার কথা, তাদের কাছ থেকে সে ক্ষমা অর্জন করতে হবে।

সে লেখায় দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। একদল পাঠকের বক্তব্য ছিল, একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে আমরা কেউ জড়িত ছিলাম না। যে রাজনীতিবিদেরা সেই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের অধিকাংশ আর বেঁচে নেই। তাদের জীবদ্দশায়ই পাকিস্তানিরা তাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনো দায়ভার আমরা কেন বহন করব? অন্য আরেক দল পাঠক স্বীকার করেছিল, একাত্তরের গণহত্যা এক নির্মম ঘটনা। পাকিস্তানি হিসেবে তারা প্রত্যেকে সে গণহত্যা ঠেকাতে না পারার জন্য কমবেশি দায়ী। একাধিক পাঠক ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা চেয়েছিল। তাদের কেউ কেউ সরাসরি ই-মেইল পাঠিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিল, বন্ধুত্বের অনুরোধও জানিয়েছিল।

chardike-ad

একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান ক্ষমা প্রার্থনা করুক, বাংলাদেশে অনেকেই এমন দাবি তুলে থাকেন। আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা তারা প্রায় এক কূটনৈতিক যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে আসে। আমাদের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন করে সে দাবি তুলেন। আমি নিজে বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার সে দাবি তোলার কোনো কারণ দেখি না। যাদের হাতে রক্ত, জামায় রক্ত, বুকের ভেতর রক্ত, ক্ষমা প্রার্থনার দায়ভার তাদের। তাদের নিজেদের চৈতন্যের শুদ্ধির জন্যই প্রয়োজন ক্ষমাপ্রার্থনা।

একাত্তরের গণহত্যার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত, এমন পাকিস্তানির অভাব নেই। পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তিনি একাত্তরের পাকিস্তানি সেনা আক্রমণের প্রবল সমালোচক। তাঁর বাবা মালিক গোলাম জিলানি পাকিস্তানি সেনা হামলার প্রতিবাদ করায় জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। বিখ্যাত পাকিস্তানি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ একাত্তরে কোনো স্পষ্ট প্রতিবাদ না জানালেও পরে এ নিয়ে তাঁর মনস্তাপের কথা লিখেছেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে তাঁর নিজের শরীরের একটি অংশ ছিঁড়ে গেছে, একাত্তর নিয়ে লেখা তিনটি কবিতায় এমন সন্তাপ বিবৃত করেছেন। মোশাররফের ঢাকা সফরের পর পাকিস্তানের ৫১টি সুশীল সমাজভুক্ত সংগঠন এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, মোশাররফের দুঃখ প্রকাশের ভেতর দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার অনুভূতি প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান এখনো পুরোপুরি ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলে পরে এক নাগরিক মিছিল বের করা হয়। সে মিছিলের অগ্রভাগে ব্যানারে লেখা ছিল, ‘একাত্তরের গণহত্যার জন্য আমরা তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।’

এদের কারোর আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কথাতেও আমার কোনো সন্দেহ নেই যে বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে তাঁরা কেউই কোনো রকম সংহতি বোধ করেননি। একাত্তর কেবল একটি গণহত্যার ঘটনা নয়, এক বিশাল মানব গোষ্ঠীর নিরন্তর মুক্তি আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রকাশ। এ কথাটি তাঁরা আগে যেমন বোঝেননি, এখনো বোঝেন না। একাত্তরের ওপর যেকোনো পাকিস্তানির লেখা বই পড়ে দেখুন।

একাত্তরের পুরো ঘটনাটি তাঁদের চোখে একটি ভারতীয় চক্রান্ত। ভারত আগাগোড়া চেয়েছে পাকিস্তানকে ভাঙতে, তাকে দুর্বল করতে। বাংলাদেশ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সেই চক্রান্তেরই বিজয় হলো। পাকিস্তানের কোনো পাঠ্যপুস্তকে আজ পর্যন্ত একাত্তরে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি নেই। গত বছর করাচির ডন পত্রিকায় হুমা ইমতিয়াজ পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস পাঠের বিবরণ দিয়ে লিখেছিলেন, বাংলাদেশের স্কুলে হিন্দু শিক্ষকদের প্রভাবে সে দেশের ছাত্রছাত্রীদের মনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই বাংলাদেশের দাবি। অন্যদিকে ভারত আগাগোড়া চেষ্টা করেছে সেখানকার হিন্দুদের স্বার্থ তুলে ধরতে। পূর্ব পাকিস্তানে যে এক কোটির মতো হিন্দুর বাস, তাদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যেই ভারত আওয়ামী লীগের ভারতপন্থী নেতাদের সঙ্গে চক্রান্ত করে দেশটা ভেঙে ফেলে। পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকের এই যে ন্যারেটিভ, বাম-ডান সব ধরনের পাকিস্তানিই তাতে আমুণ্ডু বিশ্বাসী।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভূমিকায় ক্রুদ্ধ, এমন কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর লেখাতে দেখেছি, তাঁরা ভাবেন সমস্যাটি কিছু বিভ্রান্ত রাজনীতিকের ভুলের কারণে সৃষ্ট। দু-চারজন আছেন, যাঁদের বাঙালিদের জন্য কপট ভালোবাসার শেষ নেই। যেমন হাসান জহির, যিনি ষাটের দশকে ও একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে কিছুদিন কাটিয়েছেন। তাঁর ধারণা, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের সৃষ্টি আসলে ১৯৪০ সালে লাহোরে গৃহীত পাকিস্তান প্রস্তাবের প্রকৃত বাস্তবায়ন। ভারতের মাটিতে মুসলমানদের জন্য মুক্ত স্বদেশভূমির নির্মাণ ছিল সে প্রস্তাবের লক্ষ্য। বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে ভারতের মাটিতে দ্বিতীয় মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্ভব সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। এই থিসিস মাথায় রেখে ভদ্রলোক তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দি রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম। আরেক নামজাদা বুদ্ধিজীবী আকবর এস আহমদ, একাত্তরের আগে তিনিও বাংলাদেশে কয়েক বছর কাটিয়েছেন জেলা প্রশাসক হিসেবে। সেই যুক্তিতে বাঙালিদের মন-মানসিকতা বিষয়ে তাঁর মহা পাণ্ডিত্য। আকবর আহমদের বিখ্যাত বই, জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেন্টিটি। তাতে ভদ্রলোক বাঙালিদের একহাত নিয়ে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলা গভীর শোকাবহ ঘটনা, কিন্তু আলাদা দেশের দাবি করে বাঙালিরা মোটেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেনি। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের এখন যে অবস্থা, তাতে দেশের মানুষ দেশ ভাঙার জন্য নিজের হাত নিজেই কামড়াচ্ছে।

গল্প-উপন্যাসে পাকিস্তান বিভক্ত নিয়ে তেমন লেখা চোখে পড়েনি। যে দু-চারটি দেখেছি, তাতে বিহারিদের জন্য কুম্ভিরাশ্রুই বেশি। একমাত্র যে উপন্যাস পড়েছি ইংরেজি অনুবাদে তার নাম ব্রেকিং লিংকস। রাজিয়া ফাসিহ আহমদের লেখা সে উপন্যাস পড়ে মনে হয়েছে, পাকিস্তানের দুই অংশের মনুষের মধ্যে যদি আরও বেশি সংখ্যায় বিয়েশাদি দেওয়া যেত, তাহলে দেশভাগটা ঠেকানো যেত। ভদ্র মহিলার উর্বর মস্তিষ্কে এমন এক উদ্ভট কল্পকাহিনি ফাঁদা হয়েছে, যার শুরু বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণ দিয়ে। সে সময় খিলজির সেনাদলের এক তুর্কি সেনা কাসিম বঙ্গদেশ বিজয়ের পর প্রেমে পড়ে মুকুল নামের এক বাঙালি ললনার। তাদের বিয়ে হয়, ছেলেমেয়েও হয়। বঙ্গদেশের আবহাওয়ায় টিকতে না পেরে কাসিম সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি না গড়ে পাড়ি জমায় আজকের পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে সে আরেক বিয়ে করে। এই কাসিমের দুই বউয়ের সন্তানসন্ততি দিয়েই পরবর্তী সময়ে ভরে যায় ভারতের পুবে আর পশ্চিমে। এরাই শেষ পর্যন্ত লড়কে নেয় পাকিস্তান। কাসিমের এই সব নাতি-পুতিরা যদি তাদের বড় দাদার উদাহরণ মাথায় রেখে বিয়েশাদি করত, তাহলে সব মুশকিলেরই আসান হতো।

হায়, এই গল্প যদি দুই পাকিস্তানের মানুষেরা সময়মতো জানত, তাহলে কী আর পাকিস্তান নামের এমন মহান এক দেশ ভেঙে দুই টুকরো হয়! নতুনবার্তা।