Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মুক্তাদির সূরা ফাতেহা পাঠ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় কিছু বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা-পর্যালোচনা_ এমনকি এ নিয়ে বিতর্ক-বাহাস এবং চরম হৈচৈ লক্ষ করা যায়। যেমন নামাজে মুক্তাদির সূরা ফাতেহা পড়া, নামাজে হাত বাঁধা ও রফে ইয়াদাইন বা বারবার হাত ওঠানো ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের মূল উৎস দুটি_ কোরআন ও সুন্নাহ। একজন মোমিন ও মুসলিম হিসেবে আমরা মূলত এরই অনুসরণ করি। এটি তাদের পক্ষে সম্ভব, যারা কোরআন ও হাদিসের পা-িত্য অর্জন করেছেন; কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ, তারা আলেমদের অনুসরণ করবেন। এ প্রসঙ্গে কোরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা না জানলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো।’ (সূরা নাহল : ৪৩)। যিনি কোরআন ও হাদিস নিজে বুঝে আমল করবেন তিনি মুজতাহিদ, আর যিনি অন্যের কাছে শুনে বা অন্যকে দেখে আমল করবেন তিনি মুকালি্লদ। আর এ কর্মটি হলো তাকলিদ। মুজতাহিদের মতের ভিন্নতাকে মাজহাব বলা হয়। মূলত মাজহাব হলো, ইসলামী শরিয়তের ব্যাপারে দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত সুষম ব্যাখ্যা। তাকলিদ হলো, মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসরণ, মুকালি্লদ অর্থ হলো, অনুসারী। এটিই কালক্রমে মাজহাব নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

ইমাম বোখারি (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.) ও ইমাম তিরমিজি (রহ.)সহ বড় বড় মুহাদ্দিসরা মুজতাহিদ ছিলেন। তাই তাদের কাউকে মানলেও মাজহাব মানা হয়। মাজহাব সংখ্যাও অনেক কিন্তু সব মাজহাব ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়নি, যার কারণে হানাফি, শাফিয়ি, মালিকি ও হাম্বলি_ এ চার মাজহাবই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। হানাফি মাজহাবের ফজিলত (শ্রেষ্ঠত্ব) হলো, এ চার ইমামের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবু হানিফা (রহ.) হলেন তাবেয়ি, আর বাকি তিনজন হলেন তাবে-তাবেয়ি। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর ৮০ ভাগ মুসলিমই হানাফি মাজহাবের অনুসারী।

chardike-ad

হাদিস অনুসারে আমল করা প্রসঙ্গে অনেকে বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, ‘কোনো হাদিস সহিহ প্রমাণ হলে সেটাই আমার মাজহাব।’ সুতরাং বলা যায়, তিনি তার মাজহাব অনুসরণ করতে বলেননি বরং সহিহ হাদিস অনুসরণ করতে বলেছেন। তাই যারা মাজহাব না মেনে হাদিস অনুসরণ করেন, তারাই সঠিক পথে আছেন। এর উত্তর হলো, একই বিষয়ে যে একাধিক (বিপরীতমুখী) সহিহ হাদিস রয়েছে এবং যেসব হাদিস (শাব্দিকভাবে কোরআনের বিপরীত) আমরা সেগুলো কীভাবে আমল করব? যেমন বোখারি শরিফে (পৃষ্ঠা ১০৫, পরিচ্ছেদ ১১৭, হাদিস ১৫৯) বলা হয়েছে, অজুর অঙ্গগুলো একবার ধোয়ার কথা, আবার বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা ১০৫, পরিচ্ছেদ ১১৭, হাদিস ১৬০) দু’বার ধোয়ার কথা এবং আবার বলা হয়েছে, (পৃষ্ঠা ১০৫, পরিচ্ছেদ ১১৭, হাদিস ১৬১) তিনবার ধোয়ার কথা। এখন আমরা কোনটা আমল করব? এর জন্য প্রয়োজন মুজতাহিদ কর্তৃক প্রদত্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা। আর এসবের সঠিক ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন সাহাবিদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। যেহেতু সাহাবিদের কথাও দলিল। (সহিহ বোখারি, পৃষ্ঠা ১০৬, পরিচ্ছেদ ১২০)। অনুরূপ তাবেয়িদের আমলও দলিল। বোখারি শরিফ (পৃষ্ঠা ১০৮, পরিচ্ছেদ ১২৪, হাদিস ১৬৬/পরিচ্ছেদ ১২৮)।

ইসলামী শরিয়তের ফিকহ বা ব্যবহারিক বিধানের উৎস চারটি_ ১. কোরআন, ২. হাদিস, ৩. ইজমা ও ৪. কিয়াস। সাহাবায়ে কেরাম ইজমার ওপর আমল করার চেষ্টা করতেন। (সহিহ বোখারি পৃষ্ঠা ১১৪, হাদিস : ১৭৯)। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ইখতিলাফ থাকলে মুজতাহিদ তাহকিকের মাধ্যমে একটাকে প্রাধান্য দিতে পারেন। যেমন ইমাম বোখারি (রহ.) নিজেও এমনটা করেছেন। বোখারি (পৃষ্ঠা ১০৯, পরিচ্ছেদ ১২৫, হাদিস : ১৬৭)। কিয়াস করার বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা:) কর্তৃক অনুমোদিত। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম শরিফ)। ইমাম বোখারি (রহ.) নিজেই বোখারি শরিফে হাদিস বর্ণনা করে কখনও কখনও নিজ বর্ণিত হাদিস অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না দিয়ে ইজতিহাদ করে মাসয়ালা দিয়েছেন এভাবে, ‘কালা আবু আবদুল্লাহ’ (আবু আবদুল্লাহ বোখারি বলেছেন), যাতে তার গবেষণার প্রতিফলন ঘটেছে। (সহিহ বোখারি, গোসল অধ্যায়)।

সুতরাং পরিষ্কার বলা যায়, শুধু সহিহ হাদিস সঙ্কলন ইমাম বোখারি (রহ.) এর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং নিজ ইজতিহাদকৃত মাসয়ালাকে প্রমাণ করাই তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না, বোখারি নিছক কোনো সাধারণ হাদিস গ্রন্থ নয় বরং এটি বোখারি মাজহাবের ফিকহের কিতাব, যাতে তিনি তার মাজহাবের দলিল পেশ করেছেন। তাই যারা বোখারিতেই বা অন্য মাজহাবের কিতাবে হানাফি ফিকহের দলিল খোঁজেন, তাদের জানা দরকার, আসলে ওটি ভিন্ন মাজহাবের কিতাব। সুতরাং হানাফি মাজহাবের দলিল সেসব কিতাবে পাওয়া যাবে না, যেমন অন্য মাজহাবের দলিল হানাফি মাজহাবের কিতাবে পাওয়া যাবে না। তাই হানাফি ফিকহের দলিল হানাফি মাজহাবের কিতাবেই খুঁজতে হবে। (যেমন তহাভি শরিফ)।

মুজতাহিদের মতামত, ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত ছাড়া সরাসরি কোরআন ও হাদিস অনুসরণ করা সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভব নয় এবং নিরাপদও নয়। কারণ কোরআনের নাসেখ মানসুখ না জানলে তা আমল করা যাবে না; যেমন ব্যভিচারের শাস্তি সর্বসম্মতভাবে রজম; কোরআনের এ আয়াতটি তেলাওয়াত মানসুখ হুকুম বহাল, আবার সূরা নিসার ১৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হদের হুকুম মানসুখ তেলাওয়াত বহাল। হাদিসেরও অনুরূপ নাসেখ মানসুখ রয়েছে; তাই কোরআন ও হাদিসের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলে শুধু অনুবাদ পড়ে বা বিচ্ছিন্ন দু-একটি আয়াত অথবা বিক্ষিপ্ত দু’চারটি হাদিস পড়ে তদনুযায়ী আমল করা সমীচীন হবে না। যেমন সহিহ বোখারি শরিফের হাদিসে উল্লেখ আছে, আবু মুসা আশআরি (রা.) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, যদি কারও ওপর গোসল ফরজ হয়, অতঃপর এক মাস ধরেও পানি না পায়; তবে কি সে তায়াম্মুম করে নামাজ পড়বে না? আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, না তায়াম্মুম করবে না, যদি এক মাসও পানি না পায়। (সহিহ বোখারি, প্রথম খ-, তায়াম্মুম অধ্যায়, পৃষ্ঠা ১৯৪, পরিচ্ছেদ ২৪০, হাদিস ৩৪০)।

যারা মাজহাব মানেন না এবং নিজেদের আহলে হাদিস বা সালাফি দাবি করেন তারা হয়তো সবাই মুজতাহিদ (যা অসম্ভব) অথবা বোখারি (রহ.) এর মাজহাব বা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এর মাজহাব, তা না হলে মহল্লার ইমামের মাজহাব (যার ইজতিহাদের যোগ্যতা আদৌ নেই) নতুবা নিজের মাজহাব তথা নফসে আম্মারার অনুসরণ করেন। কেননা মুকালি্লদ বা মুজতাহিদ হওয়া ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই।

সব মুজতাহিদই দলিলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন; তাই যে কোনো একজন মুজতাহিদকে অনুসরণ করা মানে হলো কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করা, কারণ মুজতাহিদ কোরআন ও সুন্নাহ থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সুতরাং এমনটি বলা উচিত নয়, এটা একমাত্র সঠিক ওটা সম্পূর্ণ ভুল; যেহেতু প্রত্যেকের জবাবদিহিতা হবে তার এলম ও নিয়ত অনুযায়ী। আমরা সাধারণ মানুষ যারা কোরআন ও হাদিস গভীরভাবে অনুধাবন করার সামর্থ্য রাখি না, তাদের কোনো একটি মাজহাব অনুসরণ করার বিকল্প নেই। আর হানাফি মাজহাবের সিদ্ধান্ত হলো, মুক্তাদি সূরা ফাতেহা কোনো অবস্থাতেই পড়বে না, রফে ইয়াদাইন করতে হবে না, আমিন আস্তে বলতে হবে। আলোকিত বাংলাদেশ।