মুসলিম বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান আল-আজদি আস সুফি আল-ওমাবি (৭২২- ৮০৪/৮১৩)। আরবের দক্ষিণাংশের বাসিন্দা আজদি গোত্রের হাইয়ান ছিলেন তার পিতা। চিকিৎসক পিতার সন্তান হলেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে উমাইয়া খলিফা তার পিতাকে মৃত্যুদ- প্রদান করলে বাল্যকালে তিনি চরম দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হন। শৈশবে কুফায় বসবাস করলেও পিতার মৃত্যুর পর তিনি দক্ষিণ আরবে স্বগোত্রে ফিরে আসেন। স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়ালেখার হাতেখড়ি হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি গণিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে ইয়েমেনের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হারবি আল-হিময়ারির ছাত্র হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। তিনি পিতার মতো চিকিৎসাবিদ্যায়ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।
ইমাম জাফর আস সাদিকের সানি্নধ্য লাভের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিজ্ঞানে বিশেষ করে রসায়ন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হন। ঐতিহাসিক ইবনে খালি্লকানের মতে, ‘জাবির এ সময়ে জাফর আস-সাদিকের ৫০০ বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ সনি্নবেশ করে একটি ২ হাজার পৃষ্ঠার বই সঙ্কলন করেন।’ খলিফা হারুন-আর-রশিদের শাসনামলে তিনি বাগদাদে বসবাস করেন এবং খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে বাগদাদে বসবাস ও আব্বাসীয়দের রাজকীয় অনুগ্রহের স্বাদ তার পক্ষে বেশিদিন উপভোগ করা সম্ভব হয়নি। আব্বাসীয় উজির বার্মাকীয়দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হলে তিনি বাগদাদ থেকে পালিয়ে কুফায় চলে আসেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কুফায় বসবাসের সময় তিনি রসায়ন শাস্ত্র গবেষণায় বিশেষ মনোযোগী হন। ওই পরিপ্রেক্ষিতে কুফায় একটি রসায়ন গবেষণাগারও প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম ঐতিহাসিকরা ওই গবেষণাগারকে পৃথিবীর প্রথম রসায়নাগার বলে অভিহিত করেছেন। তবে বর্তমানে ওই গবেষণাগারের কোনো অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই।
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় দ্রব্যাদি প্রস্তুত করার কাজে তার প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রসায়নের প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো চর্চা করার উপায় উদ্ভাবন করেন। তিনি পাতন, ঊর্ধ্বপাতন, পরিস্রবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভস্মীকরণ, বাষ্পীভবন, গলানো প্রভৃতি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করেন। ইস্পাত তৈরি, ধাতুর শোধন, তরল বাষ্পীকরণ প্রণালি, বস্ত্র ও চর্ম রঞ্জন, ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ের ও লোহার মরিচা রোধক বার্নিশ, চুলের নানাকরণ কলপ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। সোনার বদলে মারকাসাইট থেকে উজ্জ্বল রঙের কালি প্রস্তুত প্রণালি আবিষ্কার তার অন্যতম কৃতিত্ব। তিনি ম্যাঙ্গানিজ ডাই-অঙ্াইড থেকে কাচ, সিরকা পাতনপূর্বক সিরকাপ্রধান অমস্ন, গন্ধককে ক্ষারের সঙ্গে তাপ দিয়ে লিভার অব সালফার এবং মিল্ক অব সালফার, জলীয় লতাগুল্ম, পটাশ ও সোডা এবং এগুলোর সঙ্গে এসিড মিশ্রিত করে লবণ তৈরি করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সাইট্রিক এসিড, আর্সেনিক, এন্টিমনি, সিলভার-নাইট্রেট, কিউরিক ক্লোরাইড প্রভৃতি রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারও তিনি জানতেন।
রসায়ন শাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা, খনিজ পদার্থ বিশেষত পাথর, দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে অবদান রাখেন। তিনি প্রায় ২ হাজার বই রচনা করেন। এর মধ্যে চিকিৎসা বিষয়ে বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তার আল-জহর বা বিষ নামক গ্রন্থটি মৌলিক গ্রন্থের তালিকায় বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অন্য বিষয়ে পা-িত্য থাকলেও রসায়ন শাস্ত্রে অবদানের জন্য তিনি আজও সবার কাছে সমাদৃত হয়ে আছেন। ঐতিহাসিক আবদুল মওদুদের মতে, ‘জাবির ছিলেন আরবি কিমিয়ার জন্মদাতা এবং সম্ভবত জগতের সর্বপ্রথম রসায়নবিদ।’
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
আলোকিত বাংলাদেশের সৌজন্যে।