Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কর্মহীন উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

কর্মহীন উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি
কর্মহীন উচ্চপ্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি হলেও অনেক সময় কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ে না। এ অবস্থাকেই বলা হয় কর্মহীন প্রবৃদ্ধি। শব্দগুচ্ছটি প্রথম ব্যবহার করে ইউএনডিপি, ১৯৯৩ সালে তাদের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে। তাদের ভাষ্যে, বিশ্বের অনেক দেশই এক নতুন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছে। এসব দেশে উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না। এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, যা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে নীতিনির্ধারকদের।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মস্থানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। কিন্তু এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হারে বাড়ছে না কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি। বরং কমছে।

chardike-ad

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রণীত ‘এমপ্লয়মেন্ট ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক পর্যালোচনায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত সংস্থাটির পর্যবেক্ষণ বলছে, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একই সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ১১ শতাংশে। আর এ সময় কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আরো বেড়ে হয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি না বেড়ে বরং কমে যায়। এ সময়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে একই হারে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি না হওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। তবে শিগগগিরই এ পরিস্থিতি বদলে যাবে বলেও মনে করেন তিনি। বণিক বার্তাকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি সবসময় পূর্ণ গতিতে বৃদ্ধি পায় না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা পর্যায়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা কমে যায়। আর বাংলাদেশও তেমনই একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে শিগগিরই এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে। দেশে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন দেখতে পাওয়া যাবে। সেজন্য সরকারের শিল্পায়ন পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে হবে। কারণ দক্ষতা ঘাটতির প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিতে। আর দক্ষতা উন্নয়নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা কমে গেলে প্রবৃদ্ধির উচ্চহার সত্ত্বেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সাফল্য সেভাবে পাওয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল শ্রমবাজারে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয় না। তাদের মতে, দেশের শ্রমঘন খাতগুলো এখন ক্রমেই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলেও তা কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরি এ প্রসঙ্গে বলেন, আগে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হতো, এখন তা হচ্ছে না। যেসব খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা একসময় শ্রমঘন হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন শ্রমঘনত্ব কমেছে। এছাড়া শুধু প্রবৃদ্ধি হলেই হবে না। প্রবৃদ্ধির গুণগত মানও ভালো হতে হবে। আর মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি হলে সব খাতের কর্মসংস্থানে ভারসাম্য আসত। আমাদের এমন নীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন, যাতে সব খাতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতের প্রতিফলন রয়েছে এডিবির পর্যালোচনায়ও। উন্নয়ন সংস্থাটি বলছে, একমাত্র ম্যানুফ্যাকচারিং খাতেই কর্মসংস্থানের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে এ খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ সময়ে খাতটিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর পর ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে দেশের সবচেয়ে শ্রমঘন শিল্প তৈরি পোশাক। সত্তরের দশকে যাত্রা করা এ শিল্পে এখন কর্মরত ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক। তবে এ শিল্পও এখন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে।

দেশের আরেক শ্রমঘন খাত নির্মাণ শিল্প। কয়েক বছর ধরেই খাতটিতে কর্মসংস্থানে স্থবিরতা চলছে। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময় পর্যন্ত নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়ে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে এ খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। এ সময়ে নির্মাণ খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।

এমপ্লয়ারস ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, দেশের নির্মাণ খাতের কর্মসংস্থান কমে গেছে ব্যাপক হারে। আবার শ্রমঘন পোশাক খাতেও প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ছে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। মোটা দাগে বলতে গেলে এর জন্য প্রথমেই শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে আরো মনোযোগী হওয়া উচিত। আর সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দেশের কর্মজীবী মানুষের পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহারের লক্ষ্যে সব খাতের উন্নয়ন প্রয়োজন। তাহলে অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য আসবে।

নির্মাণ শিল্পের মতোই কৃষি খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়ে এ খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ থাকলেও ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে তা কমে দাঁড়ায় দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

একইভাবে কমছে সেবা খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিও। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে এ খাতে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি থাকলেও পরের পাঁচ বছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৯৩ শতাংশে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সময়ে কর্মসংস্থানের এ প্রবৃদ্ধি আরো কমে দাঁড়ায় ১ দশমিক ২১ শতাংশে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির উৎস আর কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির উেসর মধ্যে তারতম্য দেখা যাচ্ছে। পোশাক খাত ছাড়া অন্যান্য খাতের প্রবৃদ্ধি যেমন হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। বেসরকারি বিনিয়োগও প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ছে না। সেবা, কৃষি ও নির্মাণের মতো খাতগুলোতেও কর্মসংস্থান কমেছে। আবার কর্মসংস্থানে প্রবাসীদের তথ্যও প্রতিফলিত হচ্ছে না। সব মিলিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির মধ্যে অসামঞ্জস্য থেকে যাচ্ছে।