Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পরামর্শ ফির নামে ৬১৫ কোটি টাকা পাঠিয়েছে বিএটিবি

batc

যুক্তরাজ্যে অবস্থিত বিএটি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে কারিগরি ও পরামর্শসেবা নিয়ে থাকে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। এ সেবার নামে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর বড় অংকের অর্থ হোল্ডিং কোম্পানিতে পাঠাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। গত নয় বছরে এ ধরনের সেবার ফি বাবদ ৬১৫ কোটি টাকার বেশি সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করেছে বিএটিবি। অর্থাত্ কারিগরি ও পরামর্শ ফি বাবদ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ কোটি টাকা পরিশোধ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

chardike-ad

বিএটিবির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে কারিগরি ও পরামর্শ ফির নামে বিএটি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সেবামূল্য দাঁড়িয়েছে ৯৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে এ ধরনের সেবামূল্য ছিল ৮৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এছাড়া ২০১৩ সালে ৬৩ কোটি ১০ লাখ, ২০১২ সালে ৭৮ কোটি ৬৯ লাখ ও ২০১১ সালে কারিগরি ও পরামর্শ ফির নামে ৭৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিএটিবি। এর আগে ২০১০ সালে কারিগরি ও পরামর্শ ফির নামে ৫০ কোটি ৪৭ লাখ, ২০০৯ সালে ৫৫ কোটি ৩৮ লাখ, ২০০৮ সালে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ও ২০০৭ সালে ৫০ কোটি ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করে বিএটিবি।

এ ব্যাপারে জানতে গত মঙ্গলবার বিএটিবির সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। গতকাল বিএটিবির কোম্পানি সচিব আজিজুর রহমানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হলেও এ মুহূর্তে মন্তব্য করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের সমন্বয়ক ও করনীতি বিভাগের প্রথম সচিব শব্বির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বহুজাতিক কোম্পানির এ ধরনের ব্যয় খতিয়ে দেখতে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল মাত্র কাজ শুরু করেছে। কোম্পানিগুলোর নথিপত্র সংগ্রহের পর্যায়ে রয়েছে। এসব বিষয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ এখনো শুরু হয়নি।

বিএটিবি মূলধনি যন্ত্রপাতি, স্পেয়ার পার্টস, মোড়কজাত সামগ্রী ও তামাক পাতা আমদানি-রফতানির প্রায় সবই করে থাকে বিভিন্ন দেশে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বিএটিবির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে কাঁচামাল, মোড়কজাত সামগ্রী, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও স্পেয়ার পার্টস আমদানি বাবদ কোম্পানিটির ব্যয় ছিল ৫২৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫৯৪ কোটি টাকা। এ লেনদেনের প্রায় পুরোটাই হয়েছে আন্তঃকোম্পানির মাধ্যমে।

বিএটি হোল্ডিংস ও ইনভেস্টমেন্টস ছাড়া বিএটিবির সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় বিএএসএস জিএসডি ইউকে, বিএটি (জিএলপি) লিমিটেড, বিএটি সিঙ্গাপুর ও বিএটি এশিয়া প্যাসিফিক সার্ভিস সেন্টারের সঙ্গে। বর্তমানে বিএটি বাংলাদেশের কাছে এসব কোম্পানির পাওনার পরিমাণও বেড়েছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএটি বাংলাদেশের কাছে আন্তঃকোম্পানিগুলোর পাওনার পরিমাণ ছিল ৩২৫ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের একই সময়ে ৪০৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।

বিএটিবির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএটিবির কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ২ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। এ সময়ে কারিগরি ও পরামর্শ ফি বাবদ প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করে প্রায় ৪০৮ কোটি টাকা, যা নিট মুনাফার ১৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, আর্থিক প্রতিবেদনে ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানি কী ধরনের পরামর্শসেবা নিচ্ছে, তার বিস্তারিত বিবরণ থাকা উচিত। এতে কোম্পানির স্বচ্ছতা প্রকাশ পায়। এ ধরনের সেবার ফি যৌক্তিক হচ্ছে কিনা, তা এনবিআরের ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও খতিয়ে দেখা উচিত। অর্থ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি খতিয়ে দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এক্ষেত্রে দেখতে হবে, সেবাপ্রাপ্তির বিপরীতে প্রকৃত মূল্য যাচ্ছে, নাকি বেশি যাচ্ছে।

দেশে সিগারেট শিল্পে মোট বিক্রির দুই-তৃতীয়াংশ আসে বিএটিবি থেকে। কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালে বিএটিবি মোট ২ হাজার ৬০৬ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি করে। এ থেকে টার্নওভার ছিল ৬ হাজার ৩২৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে অভ্যন্তরীণ বাজারে সিগারেট বিক্রি বেড়ে ৪ হাজার ২৫৪ কোটি শলাকায় উন্নীত হয়, যা থেকে টার্নওভার ছিল ১৪ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এ সময় সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে ১০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

সিগারেটের মূল্য বাড়ায় কোম্পানির টার্নওভারও নিয়মিত বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিএটিবির মোট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট প্রদান শেষে কোম্পানির নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের একই সময়ের চেয়ে এ পরিমাণ প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বেশি।

২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর সময় অনুযায়ী, বিএটিবির পরিশোধিত মূলধন ৬০ কোটি টাকা। এ কোম্পানিতে বিএটিবির মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রেলিহ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এর বাইরে বিদেশী বিনিয়োগকারীর ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ছাড়াও সাধারণ বীমা করপোরেশন ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) কাছে শেয়ার রয়েছে।

মূল প্রতিষ্ঠান বিএটির ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে যে পাঁচটি দেশকে মুনাফার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ২০১৫ সালে বিএটিবি ৫৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে।

এ হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা শুধু লভ্যাংশ হিসেবে পেয়েছে মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রেলিহ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। আগের বছরও একই পরিমাণ অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে পায় রেলিহ ইনভেস্টমেন্ট। আর ২০১৩ সালে লভ্যাংশ থেকে প্রাপ্তি ছিল ২৭১ কোটি টাকা। এর বাইরে রয়্যালটি হিসেবেও প্রতি বছর বিএটির মূল কোম্পানি বড় অংকের অর্থ পাচ্ছে। ২০১৫ সালে শুধু রয়্যালটি বাবদ বিএটি হোল্ডিংস লিমিটেডকে ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে বিএটিবি। আগের বছর রয়্যালটি বাবদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বণিকবার্তা।