Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

জোগান বাড়লেও বিদ্যুৎ সংযোগে অপেক্ষা কমেনি

electricity

গত সাত বছরে দেশের বিদ্যুৎ খাতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে যেখানে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটেরও কম ছিল, এখন তা বেড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। উৎপাদনও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। তা সত্ত্বেও কমেনি শিল্প খাতে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য অপেক্ষার পালা। সংযোগের আবেদন করে মাসের পর মাস, এমনকি বছরও কেটে যায়, কিন্তু মেলে না কাঙ্ক্ষিত সংযোগ। বিদ্যুতের অভাবে অকেজো পড়ে থাকে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত অবকাঠামো।

chardike-ad

গাজীপুরের জয়দেবপুর রোডে উথা স্পিনিং মিল। কয়েক বছর আগে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন করে কারখানাটি। এজন্য প্রয়োজনীয় সব নথি, তথ্য ও অর্থ জমা দিলেও এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। উথা স্পিনিং মিলের মতো এমন হাজারো প্রতিষ্ঠানের নতুন সংযোগের আবেদন পড়ে আছে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের দপ্তরে।

ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ ও ডিসিসিআইয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের কয়েক হাজার শিল্প-কারখানার নতুন সংযোগের আবেদন জমা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (ডিপিডিসি) পড়ে আছে ১ হাজার ৭০০টি আবেদন। এছাড়া ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) কাছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ছয়টি ইউনিটের আওতায় আড়াই হাজার নতুন সংযোগের আবেদন জমা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে।

শিল্প খাতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানে বিলম্বের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার উপরে বাংলাদেশের অবস্থান। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ডুইং বিজনেস রিপোর্ট-২০১৭’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। নতুন শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বাংলাদেশে প্রায় ৪০৪ দিন তথা ১ বছর ২ মাসের মতো সময় লাগে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিল্প-কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদনের পর মাত্র ১ মাস ১৭ দিনে সংযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া শ্রীলংকায় ৩ মাস ১০ দিন (১০০ দিন), পাকিস্তানে ৭ মাস (২১৫ দিন), নেপালে ২ মাস ১০ দিন (৭০ দিন), থাইল্যান্ডে ৩৭ দিন ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ১৮ দিনে নতুন সংযোগ পান শিল্প-কারখানার মালিকরা।

এ ধরনের কালক্ষেপণের কারণে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। গ্যাস ও বিদ্যুেসবার সংকটে নতুন ব্যবসা শুরু ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার পরও যেসব নতুন শিল্প-কারখানা শুরু হয়, সেগুলোও সঙ্গত কারণে লাভের মুখ দেখে না। পাশাপাশি রয়েছে নিরবচ্ছিন্নভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহের সংকটও।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুতের ঘাটতি ও সবখানে সংযোগ লাইন না থাকাই এ কালক্ষেপণের প্রধান কারণ। তবে দুর্নীতি, ঘুষ এবং সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাবও এর জন্য দায়ী। উৎপাদন সক্ষমতা বড়লেও ঘুষ নেয়ার প্রবণতা থেকে বের হতে পারছেন না আমলারা।

প্রসঙ্গত, উৎপাদন ঘাটতির কারণে ২০১০ সালের নভেম্বরে শিল্প খাতে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ সীমিত করার নির্দেশ দেয় সরকার। তবে পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ায় গত বছরের ২৭ আগস্ট থেকে এরই মধ্যে আবেদন করেছে, এমন শিল্প-কারখানায় সংযোগ দেয়ার নির্দেশ দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। সে সময় দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর ডেসকোর এক অনুষ্ঠানে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আবেদন পাওয়ার সাতদিনের মধ্যে গ্রাহকদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর নির্দেশ দেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। কিন্তু দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের বিষয়টি। রয়েছে অপ্রাসঙ্গিক নথিপত্রের অজুহাতে বিদ্যুৎ সেবাকে কঠিন করে তোলার বিষয়। বর্তমানে ডেসকোর বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে ১১ ধরনের নথিপত্র জমা দিতে হয়। এছাড়া লাইন টানা, ওয়্যারিং ও পরিদর্শনসহ ধাপে ধাপে রয়েছে সীমাহীন বিড়ম্বনার অভিযোগ।

বিদ্যুৎ সংকটে রয়েছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গাজীপুরের ইশরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেড। চার বছর আগে কারখানাটি ছয় মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য অর্থ জমা দেয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এজন্য অনুমোদন দিলেও প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই এক মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ পেয়ে আসছে। ফলে কারখানাটির নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে উদ্যোক্তাকে।

বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ না পেয়ে ও প্রয়োজনীয় সরবরাহ না থাকায় অনেক শিল্প-কারখানাকে ভুগতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে কালক্ষেপণের পেছনে রয়েছে ঘুষ, অনিয়ম ও অপ্রয়োজনীয় নথিপত্রের শর্তারোপ। নানামুখী দুর্নীতির কারণে বাড়ছে ব্যবসায় ব্যয় ও অনিশ্চয়তা। ফলে অনেক বড় কোম্পানিও নতুন বিনিয়োগ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে।

ডিপিডিসির পরিচালক (পরিচালন) এটিএম হারুন-অর-রশিদ বলেন, চাহিদা ও নথিপত্র ঠিক থাকলে আমরা আবেদনের তিন-চারদিনের মধ্যেই সংযোগ দিয়ে দিই। তবে কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে এক্ষেত্রে দেরি হয়। এমন কয়েকটি আবেদনের বিপরীতে সংযোগ প্রদানের কাজ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।

শুধু শিল্প খাতেই নয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড, ডেসকো ও ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের অধীন আবাসিক খাতেও জমা রয়েছে হাজার হাজার আবেদন। রয়েছেন দু-তিন বছর আগে আবেদন করে এখনো সংযোগ পাননি এমন গ্রাহকও। রাজশাহী বাগমারার কাজী আবদুল মান্নান নামে এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি বিদ্যুতের জন্য আবেদন করেন। মিটারের টাকাও জমা দিয়েছেন। পরে তাকে নিজ খরচায় কেবল (তার) কেনার কথা জানানো হলে তিনি সেজন্য অর্থ জমা দেন। কিন্তু এখনো তিনি বিদ্যুৎ-সংযোগ পাননি। ওই দপ্তরের এক কর্মকর্তা তার কাছে ১০ হাজার টাকা দাবি করেন বলেও তিনি জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এ কে মনোওয়ার উদ্দীন আহমদ বলেন, শিল্প খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউটিলিটি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। কিন্তু আমাদের দেশে নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধার মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগে বিলম্ব অন্যতম। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বাড়ে লোকসান। আবার ভোক্তাদের সাধ্যের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করা যায় না। এতে সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ যত সহজ ও সুন্দরভাবে দেয়া যাবে, দেশ তত উপকৃত হবে। বণিকবার্তা।