Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

রমজানের শেষ দশক

সিউল, ১ আগষ্ট ২০১৩:

আজ ২৩ রমজান। রমজানের শেষ দশক চলছে। ২১ রমজান থেকে নাজাতের শুরু হয়েছে। হিজরি সনের নবম মাস রমজান। এ মাসকে আমাদের দেশে রোজার মাস রূপে অভিহিত করা হয়। ‘রামজুন’ ধাতু থেকে ‘রমজান’ শব্দের উৎপত্তি। অর্থ হলো- গরমের উত্তাপ, দগ্ধ করা, জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা। অর্থাৎ রোজার সঠিক উপবাস এবং উপাসনা রোজাদারের পাপকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে তাকে পবিত্র করে তোলে। রোজা ফারসি ও উর্দু ভাষার শব্দ। একে আরবিতে ‘সাওম’ বলে। রোজা ও সাওম দুটি শব্দের অর্থই বিরত থাকা, উপবাস থাকা, সংযম অবলম্বন করা। অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়ত করে সর্বপ্রকার পানাহার, সঙ্গম এবং যাবতীয় ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকর কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে রোজা।

chardike-ad

ramjan1আমরা উম্মতে মুহাম্মদীর মতো অন্য নবী-রাসুলদের উম্মতের প্রতিও রোজা রাখার বিধান ছিল। পবিত্র কোরআনে তা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য হলো, এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ মহান স্রষ্টা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ চারটি প্রসিদ্ধ আসমানি ধর্মগ্রন্থে রোজাকে চারটি নামে অলংকৃত করা হয়েছে। হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘তাওরাত’ কিতাবে রোজাকে ‘হাত’ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ পাপ ধ্বংস করা। হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘জাবুর’ কিতাবে রোজাকে ‘কুরবত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করা। হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ‘ইনজিল’ কিতাবে ‘তাব’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ পবিত্রতা লাভ করা। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ কেরআন শরিফে রোজা পালনের মাসকে ‘রামাজান’ নামে ভূষিত করা হয়েছে। এর অর্থ গুনাহসমূহকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা।

স্রষ্টার নৈকট্য লাভে ‘বেদ’ তথা ‘উপনিষদের’ বিধান অনুযায়ী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশী এবং বিশেষ বিশেষ ব্রত পার্বণে ‘নিরম্বু’ উপবাস পালন করে থাকেন। ধর্মীয় উপবাসের কৃচ্ছ্র সাধনা বিবেকবান মানুষকে শুধু স্রষ্টার নৈকট্য লাভে উৎসাহিত করে তা নয়, বরং রোজা দেহ-মনকে পবিত্র করে তোলা এবং স্বাস্থ্যরক্ষার উৎকৃষ্টতম পদ্ধতি। এ ব্যাপারে ভারতের বোম্বে মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডা. ডি সি গুপ্ত বলেন, ‘ইসলামের রোজা দৈহিক এবং আত্মিক শক্তির আকর।’ গ্রেট ব্রিটেনের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. এফ এম গ্রিমির মতে ইসলাম ধর্মের উপবাস দেহ এবং আত্মার প্রাণ। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক ডা. মাইকেল ও মেভিচ-এর মতে, বিশেষ করে রোজা রক্ত চলাচল ব্যবস্থাকে ঠিক রাখে, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, কুপ্রবৃত্তি দমন হয় এবং মন বিক্ষিপ্ত হয় না। প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. আর কেমফার্ডের মতে, রোজা পাকস্থলী পরিষ্কার করে এবং পরিপাক শক্তি বৃদ্ধি করে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ১১ মাসের খাদ্যে বছরে প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় খাদ্য দেহে সঞ্চিত হয়, যা দেহের জন্য ক্ষতিকারক এবং রোগ সৃষ্টির সহায়ক। দেহের ওই অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত খাদ্যকে রোজা রাখার এক মাসের প্রশিক্ষণে খাদ্যকে গ্রহণ না করে শরীরের ভেতর ক্ষয় করে দেওয়ার বিজ্ঞানসম্মত উপায় হচ্ছে রোজা। তা ছাড়া রক্তের কণিকাগুলো ১২০ দিন অন্তর অন্তর দেহের অস্থিমজ্জা এবং যকৃৎ থেকে উৎপত্তি লাভ করে। ফলে মানবদেহে রক্ত দূষিত হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে দেহকে ব্লাড ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে এবং অতিরিক্ত চর্বি-মেদের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করতে হলে একান্ত প্রয়োজন রোজা রাখা। এ জন্য পৃথিবীবিখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনা শরীরের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, চর্বি ও অন্যান্য ভয়ংকর রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রোগীদের একাধারে ৩-৪ সপ্তাহ উপবাসব্রত পালনের পরামর্শ দিতেন। বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মোহাম্মদ হোসেনের মতে, রোজা ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে উৎকৃষ্ট মহৌষধ। এ ব্যাপারে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একটি জাকাত বা শুদ্ধি ব্যবস্থা আছে। শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা।’

ইসলামে রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংযম এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে একদিকে নিজেকে সর্বপ্রকার কুকর্ম, কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখে দেহ-মন পবিত্র করে তোলার প্রক্রিয়ায় স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা, অন্যদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর নিজ পাড়া-প্রতিবেশী লোকজন অথবা জীবজন্তুকে রেখে তাদের সার্বিক কল্যাণে এগিয়ে না এসে উপাসনার দ্বারা যে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা যায় না, সে ব্যাপারে মানবজাতিকে বিবেকবান করে তোলা। বিশ্বের জরাজীর্ণ অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ নিবারণে শুধু বড় বড় কথা অথবা উপদেশ দিয়ে নয়, বরং কাজকর্মে এবং বিবেককে জাগ্রত করতে হলে একমাত্র রোজা হচ্ছে তার দীর্ঘ এক মাসের প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং। গরিবদের জন্য প্রকৃত দরদি হয়ে রোজার নিয়মকানুন মতো না চললে শুধু ধর্মীয় বেশভূষা ও উপবাসের দ্বারা স্রষ্টার নৈকট্য লাভের মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছা যায় না। ইসলামের পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশনা মেনে রোজা পালন করলে দৃশ্যমান বহুমুখী সুফল পাওয়া যায়। রোজা ও রমজানুল মোবারকের অন্যতম দাবি হলো, জীবনের প্রতিটি স্তরে ত্যাগ ও তিতিক্ষার শিক্ষা গ্রহণ করা। নিজে তা চর্চা করা এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করা। সুত্রঃ ঢাকা টাইমস