‘আমেরিকা প্রথম’ স্লোগান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুরু হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যাত্রা। বলা হচ্ছে, বাইরের রাষ্ট্রগুলোতে তিনি হস্তক্ষেপ করবেন না। নিজ দেশে নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। সেই ধারণা কতটুকু সত্য হবে, তা ভবিষ্যত বলে দেবে। তবে এরইমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় তবে তার শূন্যস্থানটি পূর্ণ করবে কে। অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাবের দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে আছে চীন এবং রাশিয়া। অপরদিকে পশ্চিমের নৈতিক রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠতে পারে জার্মানি।
গত কয়েক প্রজন্ম ধরে বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা হুমকিগুলোর ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন এবং ইবোলা ও হাইতির ভূমিকম্পের মতো সঙ্কট মোকাবেলায় নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে মার্কিন প্রশাসন। এবার অনেকটা অ-হস্তক্ষেপবাদী বার্তা দিয়ে ওভাল অফিসে এসেছেন ট্রাম্প। নিজের দেশের প্রতি মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। বিভিন্ন দেশের সমস্যা এবার তাদের নিজেদের মোকাবেলা করা উচিত বলেও মনে করেন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে অনেক বিনিয়োগ করে এসেছে। তাদের শিল্প, সামরিক খাত, সীমান্ত এবং অবকাঠামোতে। এটা করতে গিয়ে সে নিজেকেই ‘দৈন্যদশা আর অবক্ষয়ের’ মধ্যে ফেলেছে।
ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমেই সোমবার ট্রাম্প বাণিজ্য চুক্তি টিপিপি থেকে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এশিয়ার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের প্রভাব রুখতে এই প্রকল্পটির উদ্যোগ নেয়া হয় জর্জ ডব্লিউ বুশের সময়। এরপর বারাক ওবামা এসে তা আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেন।
চুক্তিটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়ে দেশের জন্য ‘মহান কিছু’ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। তবে রিপাবলিকানদের প্রবীণ সিনেটর জন ম্যাককেইন মনে করেন, এই প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার নেতৃত্ব চীনের কাছে ছেড়ে দিল।
এদিকে এতে শুধু চীন একাই লাভবান হবে না, বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া এবং জার্মানিও নিজের প্রভাব বিস্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বিশ্লেষকরা অবশ্য মনে করছেন, কোনো দেশ এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একইসঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক এবং নৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের ক্ষমতাশূন্যতা সৃষ্টি করবে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক নীতি বিশ্লেষক জন অলটারম্যান বলেন, ‘গত অর্ধ শতকে যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা করতে পারে এমন কোনো একক দেশ অথবা একাধিক দেশের সমষ্টি নেই। এটা একদিকে যেমন সম্পদ এবং সক্ষমতার ব্যাপার; অপরদিকে আকাঙ্ক্ষারও ব্যাপার।’
একইসঙ্গে এত কাজ করতে পারার মতো দেশ এখনো নেই বলেও মনে করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে চীন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো যেমন এই সুযোগটি নিতে চাইছে। তেমনি এশিয়া, ইউরোপের অন্য দেশগুলোও থেমে নেই। এমনকি নিজের অবস্থান জানান দিতে মরিয়া হয়ে উঠছে জার্মানিও।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নিজের প্রভাব বিস্তারে আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশুগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে হয়তো প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ইতিমধ্যে বহু দেশের সঙ্গে টিপিপির আদলে বাণিজ্য চুক্তিও করেছে দেশটি।
মার্কিন গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা আর নিজের কমিউনিস্ট মতাদর্শ শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে ট্রাম্পের আগমনকে সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছে চীন। চীনা পণ্যের ওপর কর ধার্য করে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এশিয়ার বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধের যে হুমকি দিয়েছেন তাতে উদ্বগ্ন চীনের অনেক প্রতিবেশি।
ইতিমধ্যে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আপনি পছন্দ করেন, বা না করেন- বিশ্ব অর্থনীতি হচ্ছে একটি মহাসাগর, এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবেন না।’ নিজের দেশের প্রবৃদ্ধি এবং বাইরের দেশগুলোতে বিনিয়োগের ব্যাপারে একটি পরিকল্পনাও তুলে ধরেছেন তিনি। এক সময় এ ধরনের কাজ করতো যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটগুলোরও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ন্যাটোকে ‘সেকেলে’ মন্তব্য করে এই সামরিক সংগঠনটির ব্যাপারে পুনর্বিবেচনার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। প্যাসিফিক অঞ্চল এবং দীর্ঘদিন সোভিয়েত শাসনে পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক সহায়তা নিতে হলে খরচ পরিশোধের কথাও বলেছেন তিনি।
এজন্য নিজের প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে রাশিয়াও। তবে শুধু এই কারণেই নয়, সিরীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির সরকারের অভিযানকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সমর্থন দিয়ে আসছে রাশিয়া। বর্তমানে দুই পক্ষের শান্তি আলোচনায়ও মধ্যস্থতা করছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের এখানে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন ছাড়া আর কিছুই করার নেই। যদিও তারা জানিয়েছে, সিরিয়ায় আইএসবিরোধী লড়াইয়ে রাশিয়ার পাশে আছে মার্কিন প্রশাসন। দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাব বাড়বে।
এ নিয়ে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক-ওয়াল্টার স্টেইনমেয়ার জার্মান গণমাধ্যম বিল্ডে লেখা এক নিবন্ধে জানান, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ শতকের পুরনো বিশ্বের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটল।’
এদিকে ট্রাম্পের পদক্ষেপে ‘বিশ্বায়ন বনাম বিচ্ছিন্নতা’ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বৈশ্বিক বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেতে এই সপ্তাহে দেশটি সফরের কথা রয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিটকে সমর্থন দিয়েছিলেন ট্রাম্প। আর ওবামা ছিলেন এর বিপক্ষে।
এদিকে এক সময়ে ওবামার সমালোচনা করা ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির প্রশংসা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের ব্যাপারে আর কখনো নাক গলাবে বলেও প্রত্যাশা তার। দীর্ঘদিন ধরে অগণতান্ত্রিক প্রবণতার জন্য অভিযুক্ত হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানও ট্রাম্পের প্রশংসা করেছেন।
চীনের অর্থনৈতিক শক্তি এবং রাশিয়ার সামরিক শক্তি নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে তখন অনেকে নেতৃত্বের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আর এই জায়গাটিতে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে জার্মানি। হাজারো শরণার্থী আশ্রয়দান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে বহুমুখী সংস্কৃতির দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যমে এই অবস্থান তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি।

তবে ইউরোপের অর্থনৈতিক যন্ত্র জার্মানির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। মস্কো এবং বেইজিংয়ের ‘হার্ড পাওয়ারের’ সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হবে তারা। এর চেয়েও বড় বিষয় আগামী জাতীয় নির্বাচনে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বর্তমান চ্যান্সেলর মেরকেলকে। সামনের দিনগুলোতে জার্মানি কোন পথে হাঁটবে তা নির্ভর করছে তার জয়-পরাজয়ের ওপর। মেরকেল হেরে গেলে সেখানেও উত্থান ঘটবে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির। এতে জার্মানিও পেতে পারে ট্রাম্পের মতো কোনো রাষ্ট্রপ্রধান।
সূত্র: এপি