bilসেকালে কার কত ক্রীতদাস আর রত্নরাজি ছিল, তা দিয়েই সম্পদের হিসাব হতো। এ যুগে ধনকুবেরদের ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটে সুপারইয়ট, জেট ও অবকাশকেন্দ্রের ফিরিস্তিতে। জন ক্যাম্পফনারের দ্য রিচ অবলম্বনে ধারাবাহিক আয়োজন

তার কেনা প্রাইভেট আইল্যান্ড রয়েছে বেশ কয়েকটি। প্রাইভেট জেটের সংখ্যাও একাধিক। বাড়ির গ্যারেজে দামি ও দ্রুতগামী গাড়ির সংখ্যা তার অনেক সময় মনে থাকে না। একইভাবে মনে থাকে না কতবার তিনি বিভিন্ন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হয়েছেন অথবা কতগুলো দুর্লভ চিত্রকর্ম সংগ্রহ করেছেন। প্রতি সেকেন্ডে তার সম্পদে যোগ হচ্ছে কয়েকশ ডলার। প্রতিবার পোশাক কিনতে ও চুল কাটাতে গিয়ে তাকে গলদ্ঘর্ম হতে হয় কীভাবে নিজেকে অন্যদের মতো ‘সাধারণ’ দেখানো যায়।

chardike-ad

লেক ওয়াশিংটনের তীরে পাহাড়ের শরীর কেটে নির্মিত হয়েছে তার বসতবাড়ি। সাত ধরনের পাথরের গাঁথুনিতে নির্মিত বাড়িটিতে রয়েছে অলিম্পিক সাইজের সুইমিং পুল; সেখানে আবার আন্ডারওয়াটার মিউজিক সিস্টেম। ২০ আসনবিশিষ্ট অত্যাধুনিক একটি সিনেমা হলও রয়েছে। সঙ্গে আছে বিশাল লাইব্রেরি। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত আলো, ওয়ালপেপারের আড়ালে পরিবাহিত মিউজিক সিস্টেম লাইব্রেরির এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে পাঠককে অনুসরণ করে। টিভি সেট থেকে শুরু করে আলো অথবা তাপমাত্রা— সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যায় পোর্টেবল টাচপ্যাডের মাধ্যমে। অনেক সময় তাও করতে হয় না। পৌঁছানোর পর পর অতিথিকে দেয়া হয় বিশেষ ইলেকট্রনিক পিন; সেটা পরিধান করলে অতিথি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েন বাড়ির ইলেকট্রনিক সিস্টেমে। এর পর তার পছন্দের মিউজিক, আর্ট, তাপমাত্রা ও আলো জোগানোর কাজটি ইলেকট্রনিক সিস্টেমই সম্পন্ন করে।

বলা হচ্ছে বিল গেটসের কথা। তার মা ও নানা দুজনই ছিলেন ব্যাংকার। প্রোগ্রামিংয়ের ভূত মাথায় চেপে বসায় হার্ভার্ডের পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই কাজে নেমে পড়েন বিল গেটস। বন্ধু পল অ্যালেনকে নিয়ে নিউ মেক্সিকোর প্রযুক্তি কোম্পানি এমআইটিএসের জন্য প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ লিখতেন তিনি। কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় দেয়াল ভাঙার যে প্রত্যয় হ্যাকারদের, সে অনুযায়ী এমআইটিএসের কাছে বিল গেটস ও পল অ্যালেনের বিক্রীত ল্যাঙ্গুয়েজও সবাই কপি ও শেয়ার করত। কিন্তু বিল গেটসের তাতে আপত্তি ছিল। তিনি ও বন্ধু পল অ্যালেন প্রোগ্রামার কমিউনিটির কাছে এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে খোলা চিঠি লেখেন। তারা দাবি করেন, হার্ডওয়্যারের মতো সফটওয়্যারও অবশ্যই বিক্রয়যোগ্য পণ্য এবং মূল্য পরিশোধ করেই তা ব্যবহার করা উচিত। চিঠিতে তারা প্রশ্ন করেন, ‘বিনা পয়সায় পেশাদারি কাজ কে করে দেবে? আরো খোলাভাবে বললে, আপনারা যা করছেন, তাকে স্রেফ চৌর্যবৃত্তি বলা যায়।’

১৯৭৬ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি মাইক্রো-সফটের পত্তন করেন (পরবর্তীতে হাইফেনটি বাদ পড়ে যায়)। তখনো সারা বিশ্বে বড়জোর ১০০টি কম্পিউটার ছিল। অথচ তখনই কিনা বিল গেটস স্বপ্ন দেখেছিলেন, ‘প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি ডেস্কে একটি করে কম্পিউটার, যেখানে মাইক্রোসফট সফটওয়্যার চলছে।’ একচেটিয়াত্বের এমন প্রত্যয় দেখলে আলফ্রেড ক্রুপ ও অ্যান্ড্রু কার্নেগি হয়তো খুশিই হতেন!

গেটসের প্রত্যয়ে গভীর যুক্তি ছিল। কম্পিউটারের বিশাল মার্কেটিং সম্ভাবনা তিনি চিনতে পেরেছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন, বাজারটি একচেটিয়া করে পেতে। প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতাও তার ছিল। একইভাবে ছিল দৃঢ় সংকল্প। শুধু প্রয়োজন ছিল ভাগ্যের সমর্থন। আশির দশকের শুরুতে আইবিএমের কম্পিউটারের জন্য অপারেটিং সিস্টেম সরবরাহের চুক্তি বিল গেটসের জন্য দরজা উন্মুক্ত করে। ১৯৮৫ সালে উইন্ডোজ সিস্টেম বাজারে আসে। সেবারই গুড হাউজকিপিং ম্যাগাজিনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যাচেলর তালিকায় বিল গেটসের নাম ঢুকে পড়ে। একই বছর টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনী হয় তাকে নিয়ে।

১৯৮৬ সালে বিল গেটসের কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানির একচেটিয়া মালিকানায় অন্য কাউকে অংশীদার করতে বিল গেটস প্রথমে আপত্তি জানান। অবশ্য পরে তিনি সায় দেন। কোম্পানির শুরুর দিককার কর্মীদের তিনি শেয়ার দেয়ার প্রস্তাব করেন। কর্মীরাও সম্মতি দেন, কারণ তারা জানতেন যে, তারা টাকার খনিতে বসে আছেন। আইপিও বাজারে আসার পর ৩১ বছর বয়সেই বিল গেটস বিশ্বের সবচেয়ে তরুণ ও স্বনির্মিত বিলিয়নেয়ার হিসেবে স্বীকৃত হন।

গোড়া থেকেই বিল গেটস একচেটিয়াত্বের কথা বললেও কোম্পানির আইনজীবীরা তাকে শব্দটি পরিহারের পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি মরিয়া ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাজারে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী আসতে থাকলে তার একচেটিয়াত্বের ঝোঁক আরো প্রবল হয়। নেটস্কেপ কমিউনিকেশন্স করপোরেশনের নেভিকগেটরকে বাজার থেকে হটাতে তিনি উইন্ডোজ সিস্টেমে চালিত সব কম্পিউটারে ডিফল্ট ব্রাউজার হিসেবে মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার জুড়ে দেন।

১৯৯১ সালে মার্কিন ফেডারেল ট্রেড কমিশন মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। এর পর মার্কিন বিচার বিভাগ বিষয়টি হাতে নেয় এবং ১৯৯৪ সালে একটি নিষ্পত্তি আদেশ দেয়। চার বছর পর বিল গেটসকে ওই চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে আবারো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। অ্যাপল ও নেটস্কেপকে ইন্টারনেট সফটওয়্যার বাজার থেকে তাড়াতে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ওঠে মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে। গেটস সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নের এমন হেঁয়ালি সূচক জবাব দেন যে, শুনানিতে অংশগ্রহণকারী ডিস্ট্রিক্ট জাজ বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকাতে বাধ্য হন। শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট আইন লঙ্ঘনের জন্য মাইক্রোসফট দোষী সাব্যস্ত হয়।

নির্দয় একচেটিয়াত্বের মাধ্যমে অর্থ আহরণের প্রক্রিয়া চালালেও বিল গেটসের মনোজগতে একটি পরিবর্তন চলছিল। এ পরিবর্তনের সূত্রধর ওয়ারেন বাফেট। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গেটস তার মায়ের পীড়াপীড়িতে বাফেটের একটি অনুষ্ঠানে যান। প্রথম পরিচয়টি তার খারাপ লাগেনি। এ কারণে ১৯৯৩ সালের একদিন সবার অজান্তে বান্ধবী মেলিন্ডাকে নিয়ে নিজের জেটে চড়েন। পাইলটকে নির্দেশ দেন নেব্রাস্কার ওমাহায় বিমান অবতরণ করাতে। গেটস চাইছিলেন বিনিয়োগ কিংবদন্তি বাফেটের সঙ্গে নিজের হবু স্ত্রীর পরিচয় করাতে। বাফেট সেখানে গেটসকে পরিচিত করান নতুন এক উপলব্ধির সঙ্গে। টারম্যাক থেকে বিল ও মেলিন্ডাকে নিয়ে তিনি যান জুয়েলারি স্টোর বোরশেইমে। সেখানে একটি রিং দেখিয়ে তিনি বিলকে বলেন, ‘ওয়েডিং রিংয়ের জন্য আমি নিজের আয়ের ছয় ভাগের এক ভাগ ব্যয় করেছি। আমি জানি না, তুমি মেলিন্ডাকে কতটা ভালোবাসো এবং কীভাবে অর্থ ব্যয় করতে চাও।’

ওয়ারেন বাফেটের গিভিং প্লেজ সম্পর্কে জানার পাশাপাশি বিল গেটস অর্থের আপেক্ষিকতা সম্পর্কেও জানতে পারেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হার্ভার্ড ছাড়ার সময় আমার জানা ছিল না পৃথিবীতে কী দুর্বিষহ অসাম্য বিরাজ করছে! যুক্তরাষ্ট্রে একটি জীবন বাঁচাতে ৫০-৬০ লাখ ডলার ব্যয় হয়। অথচ পৃথিবীর অনেকে দেশে ১০০ ডলারেও কারো জীবন বাঁচতে পারে। কিন্তু সেই ৩০০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কেউ অর্থায়ন করে না।

এসব ভাবনা থেকেই বিল গেটস তার অর্জিত অর্থে কল্যাণমূলক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাথমিকভাবে ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার দিয়ে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পথচলা শুরু। এ ফাউন্ডেশন কোনো কোনো বছর স্বাস্থ্যসেবায় যে অর্থ ব্যয় করেছে, খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেটও তার সমান ছিল না। সর্বশেষ, বিল গেটস প্রতি বছর অন্তত ৪০০ কোটি ডলার কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছেন।

জন ক্যাম্পফনারের দ্য রিচ অবলম্বনে সাঈদ হাসান