Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রবাসে টোনাটুনির সংসার

germany-storyটুনি এখন আর টোনার জন্য পিঠা বানায় না৷ ভাত আর ট্যাংরা মাছের তরকারি রান্না করে৷ সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে তার রান্নার কারিশমায় চমকে যাই৷ দেশে থাকতে তাকে কখনো এরূপে দেখিনি৷ একান্নবর্তী পরিবার আমাদের৷ কখনো নিজেদের সংসার তৈরি করার সুযোগ মিলেনি দেশে৷ তাই হয়তো টোনাটুনির সংসারের প্রতি আমাদের ছিল দারুণ লোভ৷ পুরোদস্তুর সংসারী সে এখন৷

অথচ তাকে কথা দিয়েছিলাম, তিন বছরের অভিজ্ঞতাপূর্ণ এ হাতে তাকে রান্না করে খাওয়াবো৷ পারিনা৷ আমার সুযোগ হয়ে ওঠেনা৷ রান্নাঘরে ঢুকলে সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেয়৷ টুনি তার অপরিপক্ক হাতে হলুদ-মরিচ দিয়ে আমার জন্য বিভিন্ন পদ রান্না করে আমাকে চমকে দিতে চায়৷ স্বামীসেবাতেই সে রাজ্য জয়ের আনন্দ উপভোগ করে৷

chardike-ad

এমন মেয়ে ভাগ্যে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার৷ দেশে যে টুনি পরিবারের গণ্ডির মানুষের মাঝে ব্যস্ত সময় কাটাতো, সে আজ কংক্রিটের চারদেয়ালের মাঝে বন্দী৷ টুনির সম্বল শুধু ইন্টারনেট, ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট ও রান্নাবান্নার হাড়িপাতিল৷

একটি ঘরে আমাদের তাজা দুটি প্রাণ, অপরিসম ভালোবাসা, ভরপেট খানাপিনা, নিত্যদিনের অভিমান ও খুনসুটি সারাবেলা৷ যেদিন থেকে সংসার নামক বস্তুটি মাথায় ঢুকেছে সেদিনই স্বপ্নটা দেখেছিলাম৷ ছোট্ট একটি সংসারের স্বপ্ন৷ টুনা ও টুনির রূপক গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম ঠিক এমনই একটি ছোট্ট সংসারের৷

মাত্র ক’দিন হলো বাস্তব জীবনের টুনিকে নিয়ে বসত গড়েছি মধ্য জার্মানির ছোট্ট ‘হালে’ শহরে৷ ক্ষণিকের বসতি৷ স্বপ্নের শহর বলতে আসলে স্বপ্নে দেখা কোন আহামরি জাকজমকপূর্ণ শহর নয়৷ এ শহরেই প্রথম বড় কোন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম৷ সেই অর্থে আমার কাছে এটি স্বপ্নের শহর বটে৷

কিছুদিন আগেও টুনি থাকতো বাংলাদেশে, আমি ছিলাম ছন্নছাড়া একটি তৃষ্ণার্ত জীবন নিয়ে সূদুর জার্মানিতে৷ অস্থির দুটো জীবন ছিল৷ অনেকটা পৃথিবীর দুই প্রান্তে ভেসে বেড়ানো দুই টুকরো মেঘের মতো৷ অপেক্ষার প্রহর গুনতাম৷ কবে সেই পুঞ্জিভূত মেঘ বাতাসে ভাসতে ভাসতে এক হয়ে কোন একদিন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরবে৷

টুনিকে নিয়ে এখন অন্যের শহরে উঁচুতলাতে ভাড়া করা ছোট্ট কুটিরে বাস করছি৷ তার সঙ্গে থাকতে পারাটা আজন্ম স্বপ্নপূরণের আনন্দ মনে হয়৷ সাময়িক পুলকিত জীবনে এমনটাই বোধ করি যেন, জীবনে এর থেকে বড় স্বপ্নপূরণ কখনো হতে পারেনা৷

তবে এখানকার মাটিতে পা ফেলার দিনটি আমার আর টুনির জন্য মোটেও সুখময় ছিল না৷ দুটি মানুষের চারটি হাতে চারটি দৈত্যসম লাগেজ৷ তার মধ্যে একটির চাকা ভেঙ্গে পঙ্গু হয়ে যাওয়া৷ ব্যাপারটা মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো ছিল৷ সঙ্গে আরো দুটি ছোট লাগেজ৷ সব মিলিয়ে অসহায় অবস্থা৷ এর থেকে অসহায় দিন জীবনে হয়তো কখনো আসেনি৷ এমনই দেশ যে ডাকলেও রিকশা, ভ্যান, ভটভটি পাওয়া যায় না৷ ট্যাক্সি মিলে বটে, তবে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার তখন৷

এদিকে টুনিকে ভিনদেশে প্রথম অবস্থায় মানসিকভাবে শান্তিতে রাখা আমার জন্য ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ বাবা-মাকে রেখে সদ্যপরিচিত একটি ছেলের হাত ধরে এতো দূরের পথ পাড়ি দিয়ে সুখে থাকা একটি মেয়ের জন্য আসলেই অকল্পনীয়৷ আমি নিজেও খুব আবেগপ্রবণ মানুষ৷ আমি বুঝি এটা অসম্ভব৷

জার্মানিতে আমি প্রথম যেদিন পাড়ি জমিয়েছিলাম, শুরুর দিকে একটি মাসে এমন খুব কম দিনই ছিল যেদিন আমার চোখে পানি ছিল না৷ অনাথের মতো জীবন ছিল আমার৷ এমন অসহায় অবস্থা হয়তো হতো না, যদি না দেশে শিক্ষা জীবনটা বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে কাটাতে পারতাম৷ বাবা-মাকে ছাড়া জীবনে থাকার অভিজ্ঞতা কোন কালেই ছিল না৷

দিনে-রাতে-স্বপ্নে-কল্পনায় বাবা মা ভাই বোনদের দেখতাম৷ তাদের মুখের সাধারণ কথাগুলো সবসময় কানে বাজতো৷ দিন দিন একটু একটু করে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছি৷ বাবা-মা বা ভাই-বোনদের মুখের সাধারণ কথাগুলো আর আমার কানে ভাসে না৷ এরই মাঝে বাবাকে হারিয়েছি গত বছরের মাঝামাঝি৷ ভাবনায় বিরতি টেনে টুনিকে একটিবার পর্যবেক্ষণ করি৷ সে শীতে থরথর করে কাঁপছে৷ এখানে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা, টুনির গায়ের মোটা জ্যাকেট ও কাশ্মিরি শাল ভেদ করে শরীরের ত্বকে হুল ফুটাচ্ছে৷

তবুও তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি৷ বুঝতে পারছিলাম, টুনি ভালো থাকার অভিনয় করছে৷ আমি যাতে মানসিকভাবে আহত না হই সে ব্যাপারেও টুনি সজাগ৷ এক কথায় বুদ্ধিমতি মেয়ে বলা যায়৷

প্রকৃতির রূপ আসলে প্রতিটি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলে৷ মেঘলা আকাশে মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি জীবনের বিয়োগাত্মক কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়৷ অনাকাঙ্ক্ষিত শীতল প্রকৃতি এখন সেই রূপেই বিরাজমান৷ টুনির মনও আজ বিয়োগাত্মক৷ সে এখন দেশের মা-মাটি থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে৷ এমন অলস সময়ে ভালো থাকা কঠিন

এটা সত্য যে প্রতিটি মেয়েই বিয়ের পরে বাবা-মায়ের ভালোবাসার জায়গাটা স্বামীর কাছ থেকে পাবার স্বপ্ন দেখে৷ সমস্যা হলো স্বামীর পক্ষে তার বাবা-মায়ের ভালোবাসা পূরণ করা কঠিন কাজ৷ এটা পুরুষের জীবনের একটি বড় রকমের ব্যর্থতার জায়গা৷ তারপর চেষ্টা করা যায় যতটুকু পারা যায়৷ সে হোক ভালোবাসার দাবিতে অথবা ভালো থাকার চেষ্টায়৷

টুনি এখন ভালোবাসা পেলে ফুপিয়ে কাঁদে৷ বাবা মায়ের ভালোবাসা পাবার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়! আবার মানসিক আঘাতেও কাঁদে৷ কেন সে বাবা মাকে ফেলে এ নরাধমের সঙ্গে এতো দূরে এলো! তবু সে নিজ সংসারে ভালো আছে৷ ভালো থাকার চেষ্টা করছে৷

সূদুর ভবিষ্যতে সৃষ্টিকর্তা আমাকে কোথায় রেখেছেন আমি বা টুনি কেউ জানিনা৷ একরকম অনিশ্চিত দুর্বার জীবন আমাদের৷ ডক্টরেট অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেই হয়তো চাকরি থেকে আমার সাময়িক ইস্তফা দিতে হবে৷ ভবিষ্যতে সৃষ্টিকর্তাই বলে দেবে টুনির হাত ধরে কোথায় পাড়ি জমাবো৷ আমার দেশ আমার মতো দুর্বল মানুষকে গ্রহণ করলে খুব ইচ্ছা আছে বাকি জীবনটা টুনির হাত ধরে দেশে মা-মাটির সংস্পর্শে থাকার৷

টুনির এখানে কেউ নেই৷ মা নেই, বাবা নেই, ভাই বোন আত্মীয়-স্বজন নেই৷ আপন বলতে শুধু আছি এই আমি৷ আর আছে কিছু প্রতিবেশি৷ প্রতিবেশিরা কেউই টুনিকে চেনে না৷ আমি বা টুনি তাদের দেয়ালের ওপারেই আছি৷ এরা আসলে কেউ কাউকে চেনে না৷ শহুরে প্রতিবেশি যেমন হয় আরকি!

দেশের জন্য টুনির অস্থিরতা আজো কাটেনি৷ মন খারাপের প্রতিটি দিনই আমাকে ভাবিয়ে তুলে৷ সার্কাসের জোকারের মতো মন ভালো করায় ব্যস্ত আমি৷ এরই মাঝে অন্যের দেশে টুনাটুনির হাজারো স্বপ্ন দেখার পায়তারা৷

লেখক: মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকে
সৌজন্যে: বিডিনিউজ