Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গার্মেন্ট শিল্প যেভাবে বাংলাদেশে

অনেক রক্তপাত, ধ্বংস ও অপেক্ষার পর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা শুরু। সে সময়ে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের কারণে লাখ লাখ মানুষ জীবন হারায়। যুদ্ধোত্তর দেশটি নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। নৈরাজ্য আর নৈরাশ্যে ভরা। স্বাভাবিকভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিলেন বিশ্বনেতারা। এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই— তারা এমনই মনে করতেন।

এ অবস্থা ভাবিয়ে তোলে দেশ-বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের। এমনই দুই ব্যক্তিত্ব আবদুল মজিদ চৌধুরী ও নুরুল কাদের। তারা মার্কিন মুলুকের বাংলাদেশী ব্যবসায়ী। দুই বন্ধু দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। মজিদ চৌধুরীর স্বগতোক্তি, ‘নিজেদের প্রশ্ন করি, আমাদের কী দরকার?’ অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর দুজনেরই জানা ছিল, ‘আমরা কাজ চাই। আমরা ডলার চাই।’

chardike-ad

다운로드তাদের পাশে যেন সহায় হয়ে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। সময়টায় ভীষণ অস্পষ্ট, তবে বিশাল আকারের এক বাণিজ্য চুক্তি হয়। ফলে বাংলাদেশেও শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। এ যুগসন্ধিক্ষণে যুক্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার নামটিও। শুরু হয় ‘কিমচি’ নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগ্রামও।

আসুন অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাস পাঠ করি। জেনে নিই, আমাদের নীরব বিপ্লবের সর্বোত্কৃষ্ট ফসল পোশাক শিল্প সম্পর্কে। স্বাধীনতার পরে দেশের অর্থনীতি নিয়ে বলার কিছু ছিল না। অর্থনৈতিক ভিত ছিল ভীষণ নড়বড়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির তখন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। এ অবস্থায় কিছুটা হলেও স্বস্তির বাতাস বইয়ে আনে সোনালি আঁশ। আমাদের প্রধান রফতানি দ্রব্য ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। এ কারণে মজিদ চৌধুরী টেক্সটাইল শিল্পের দিকে নজর দেন। তারা জানতেন, গ্রামের দারিদ্র্য তাড়াতে বেশ কয়েকটি দেশের প্রধান হাতিয়ার ছিল এ টেক্সটাইল শিল্প। এসব ঘটনা তাকে মনে করিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কথা। অথচ চৌধুরী সাহেব টেক্সটাইলের অ আ ক খ কিছুই জানতেন না। এমনকি ‘আমার জামায় কতগুলো বোতাম আছে, তাও তো জানতাম না’—টেক্সটাইল নিয়ে এভাবে অকপটে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।

এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে বেশ কয়েক দশক আগেকার সময়ে। তখনকার দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু বিষয় জেনে নিতে হবে। দেশটির অবস্থা ঠিক আমাদের মতোই ছিল, যুদ্ধ-যন্ত্রণায় কাতর কোরিয়া। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে তারা পরিচিতি পায়। তবে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে তারা চেষ্টা চালাতে থাকে। তারা খুব স্বল্প সময়ে পোশাক তৈরির কলাকৌশল শিখে ফেলে। প্রতিষ্ঠা করে টেক্সটাইল কলকারাখানা। কয়েক বছরের মধ্যে পোশাক রফতানি করে দেশটি তরতর করে নিজেদের অভাব মিটিয়ে ফেলে। এক কথায়, দক্ষিণ কোরিয়ার পুনর্গঠনে সহায় হয়ে দাঁড়ায় তাদের গার্মেন্ট শিল্প।

দক্ষিণ কোরিয়ার এ সাফল্যে মুগ্ধ আবদুল মজিদ চৌধুরী ও তার কয়েকজন সহকর্মী দেশটিতে যান। সেই সংক্ষিপ্ত সফরে তারা এক গার্মেন্ট কারখানা পরিদর্শন করেন। কারখানাটি ছিল বিখ্যাত দাইয়ু গ্রুপের। সেখানে নারীদের সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করতে দেখেন। তত্ক্ষণাৎ তার মাথায় চিন্তা খেলে যায়, বাংলাদেশের নারীরাও তো এ কাজে পারঙ্গম। তিনি প্রবল উত্সাহ বোধ করেন। তখনই দাইয়ু গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ৪৫ মিনিটের এক আলাপচারিতার সুযোগ করে নেন। আশ্চর্যের বিষয়, সেই স্বল্প সময়ের আলাপচারিতা দেখতে দেখতে ১০ ঘণ্টায় পরিণত হয়। মিটিংয়ের ফলও ছিল ভীষণ চমকপ্রদ, আশাব্যঞ্জক। আলোচনা শেষে দাইয়ু বাংলাদেশে একটি পোশাক কারাখানায় বিনিয়োগে সম্মত হয়।

দৈবযোগে এ শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হতে থাকে। এর প্রধান উৎস ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। মূলত সত্তরের দশকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অন্য কয়েকটি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের তৈরি পোশাকের চাহিদা মেটাত। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র্রের টেক্সটাইল সম্পর্কিত চাকরি হুমকির মুখে পড়ে। ইউরোপের দেশগুলোও একই সমস্যার মুখোমুখি হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে কাজকর্ম শুরু করেন। তারা বৈশ্বিক মাল্টি-ফাইবার অ্যাগ্রিমেন্ট বা এমএফএ তৈরি করেন। আর এ চুক্তিই বৈশ্বিক অর্থনীতির রূপ বদলে দেয়।

এমএফএ অনুযায়ী কোটা পদ্ধতি চালু হয়। কোটা প্রথা অনুসারে তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে কতটা রফতানি করতে পারবে, তা নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ পোশাক শিল্পে সুষম বণ্টন সৃষ্টি হয়। এর সুফলতা ভোগ করতে থাকে স্বল্পোন্নত দেশগুলো। যেমন— শ্রীলংকা মার্কিন মুলুকে প্রতি বছর শুধু মেয়েদের বক্ষবন্ধনী রফতানি করার সুযোগ পাবে। চীন শুধু টি-শার্ট রফতানি করতে পারবে ইত্যাদি।

কাকতালীয়ভাবে মজিদ চৌধুরী দাইয়ু পোশাক কারখানা ভ্রমণের সময় দক্ষিণ কোরিয়াও এমএফএর সুবিধা ভোগ করছিল। যার দরুন কোরিয়ান কোম্পানিগুলো বিভিন্ন স্থানে তাদের কার্যক্রম চালানোর উত্সাহ পায়। যেমন ধরুন বাংলাদেশের কথা— কোরীয় কোম্পানিগুলো এমএফএ মেনে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পোশাক তৈরিতে বাংলাদেশের কারখানা ব্যবহার করতে পারবে।

এ সুযোগ লুফে নেন মজিদ চৌধুরী। তিনি ১২৮ জন বাংলাদেশীকে নিয়ে দাইয়ুতেই গার্মেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করেন। প্রশিক্ষণের ব্যাপ্তি ছিল ছয় মাস। প্রশিক্ষণটি ছিল সম্পূর্ণ ফ্রি। সাংস্কৃতিক সংঘাত শুরু হয় তখন থেকেই। ‘তীব্র কটুগন্ধযুক্ত খাবার কিমচি নিয়ে আমরা বিপাকে পড়ি’, বলেন মোহাম্মদ নুরুদ্দিন নামে এক প্রশিক্ষণার্থী। নুরুদ্দিন এখনো গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তিনি আরো যোগ করেন, ‘কিমচি একেবারেই খেতে পারতাম না। মেয়েরা তো মুখে নিয়েই বমি করে দিত।’ অবশ্য কিমচি এখন গোটা বিশ্বে বেশ পরিচিত এক খাবার। এটি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো কোরীয় খাবার। ঐতিহ্যবাহী খাবারটি প্রথম দিকে কেবল বাঁধাকপি আর গরুর মাংস দিয়ে রান্না করা হতো। কালক্রমে এর সঙ্গে মসলা হিসেবে যোগ হয় লাল মরিচ। এ খাবারে এখনো লাল মরিচের প্রাধান্যই বেশি। বর্তমানে মুলা, শশা প্রভৃতি দিয়ে দুইশরও বেশি কিমচি তৈরি হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশীদের নিয়ে কোরীয়রাও ধাঁধায় পড়ে যান। বেশভূষায় পার্থক্য তো ছিলই, ছিল চালচলনেও। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে দাইয়ুর কলার অ্যান্ড কাফ সেকশনের দায়িত্বরত প্রশিক্ষক কিম ইয়ুন হি’র (করস ঊঁহ ঐবব) কথা। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। তিনি কস্মিনকালেও কোনো বাংলাদেশীকে দেখেননি। ‘তাদের কাছে গেলেই ভিন্ন ধরনের গন্ধ পেতাম’, বাংলাদেশীদের প্রসঙ্গে স্মৃতি হাতড়ান কিম ইয়ুন। তার ভাষায়, প্রথম দিকে বাংলাদেশীদের সঙ্গে মেলামেশা খুব একটা সহজ ছিল না।
কিম ইয়ুন হি বাংলাদেশী খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেন বেশ কয়েকবার। ‘একদিন তারা আমাদের এক বিশেষ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেন। সেখানে তারা কিছু বাংলাদেশী খাবার পরিবশেন করেন। কিন্তু আমরা মুখে তুলতে পারিনি। এটা ছিল জঘন্য ধরনের খাবার’, হেসে হেসে বলেন কিম।

সময় গড়িয়ে চলে। থেমে থাকে না কার্যক্রম। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব বিব্রতকর সময়ও পার হতে থাকে। তবে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটতে থাকে খোদ দাইয়ুর বসের হস্তক্ষেপে। খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে কিম স্মরণ করেন সিইওর কথাগুলো। এখনো তার কানে বাজে সেই কথাগুলো। সেদিন সিইও সবাইকে একটি ঘরে জড়ো করে বলেন, ‘আমরা এক আন্তর্জাতিক সমাজে মিলেমিশে বাস করতে যাচ্ছি, আমাদের দুঃখকষ্ট সয়ে নিতে হবে। সুতরাং চোখ বুজে খেয়ে নিন।’

সিইওই সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জঘন্য বলে সেদিন যিনি আমাদের খাবার মুখে তোলেননি, সেই কিম ইয়ুন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে উড়ে আসেন। তারই সহায়তায় বাংলাদেশে প্রথম রফতানিমুখী গার্মেন্ট কারখানা স্থাপন হয়। কারখানাটির নাম দেশ গার্মেন্টস। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগের ফল এ দেশ গার্মেন্টস। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্যরাও বসে থাকেননি। তারা একে একে গার্মেন্ট শিল্পের পরিধি বাড়াতে থাকেন, নিজেরাই কারখানা স্থাপন শুরু করেন।

সেই শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রূপকথাকে যেন হার মানিয়ে যেতে থাকে আমাদের পোশাক শিল্পের ইতিহাস। এ শিল্পের কল্যাণে বিশ্বের বুকে আলাদাভাবে পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশ। গুনগত মান আর স্বল্প মূল্য চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে আমদানিকারকদের। এই বছরগুলোয় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক দেশের মর্যাদা অর্জন করে। সৃষ্টি করে লাখ লাখ কর্মসংস্থান। সচল করে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এত দ্রুত বদলে যাওয়ার ফলে দেশে বিভিন্ন সংকটও সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আসে রানা প্লাজার কথা। এ বছরে ভবনটি ধসে মারা যান এক হাজারের বেশি গার্মেন্ট কর্মী। এ দুর্ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আমদানিকারক দেশগুলো।

বর্তমানে বাংলাদেশে চার হাজারেরও বেশি গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে। যেভাবেই হোক, বেশির ভাগ গার্মেন্টের যোগসূত্র রয়েছে আবদুল মজিদ চৌধুরীর উদ্যোগের সঙ্গে। তিনিই এ শিল্পের আলোকবর্তিকা। আলোড়ন সৃষ্টিকারী। তার স্বপ্নের সারথি সেই ১২৮ ভ্রমণসঙ্গীও। তাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের গার্মেন্ট খাত। তাদের সম্মিলিত কর্মজীবনের উদাহরণ দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া যাবে এ দেশে? সূত্রঃ বণিকবার্তা।