Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

অসীম ক্ষমতার অধিকারী তিনি, মন্ত্রীকেও করেন না পরোয়া

nomitaপদবি তার সচিব। মন্ত্রীর অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা। কিন্তু মন্ত্রী তার কাছে কিছুই না। তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর লোক দাবি করেন। তাই মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে মন্ত্রীর দৈনন্দিন নির্দেশনা মেনে চলতেও তিনি বাধ্য নন। এই অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি হচ্ছেন ড. নমিতা হালদার।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সময়ের পরিচালক পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা মাত্র আট মাস হল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন। এখানে কার্যকাল খুব বেশি দিনের না হলেও এরই মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উপজীব্য করে মন্ত্রীর ওপর প্রভাব বিস্তারে বহুমাত্রিক চেষ্টা চালাচ্ছেন। চাকরিবিধি ও চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে তিনি মন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে একের পর এক উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহসও দেখাচ্ছেন।

chardike-ad

শুধু তাই নয়, মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে সব সময় নিজের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে মন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টিতে সংঘবদ্ধ অনুসারীদের নিয়ে একটি বিরুদ্ধ বলয় দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকারও অভিযোগ উঠেছে নমিতা হালদারের বিরুদ্ধে।

সূত্রের দাবি, কৌশল হিসেবে তিনি মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন স্তরের অনুসারী কর্মকর্তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখছেন। পাশাপাশি বিদেশ সফরের সুযোগও তৈরি করে দিচ্ছেন। আর মন্ত্রীর পক্ষে কথা বলা কর্মকর্তাদের নানা অজুহাতে কোণঠাসা করে রাখছেন।

সম্প্রতি তিনি (সচিব) মন্ত্রীকে না জানিয়ে তার আস্থাভাজন কর্মকর্তা ও রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধি নিয়ে নতুন বাজার খোঁজার নামে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিনোদন সফর করেছেন। সেখানে গিয়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে এলেও সফরের হালহকিকত প্রতিবেদন মন্ত্রীকে এখন পর্যন্ত দেননি। এমনকি সফরে বিরাট অর্থব্যয়ের বিষয়টি মন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজন মনে করেননি।

অসীম ক্ষমতাধর এ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে- সম্প্রতি মো. কামরুল ইসলাম নামে জনৈক কর্মকর্তাকে পরিচালক অভিবাসন পদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলির আদেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু এই সচিবের একরোখা মনোভাব এবং বদলিকৃত কর্মকর্তাটি তার অপছন্দের হওয়ায় গত দেড় মাসেও তাকে কর্মস্থলে যোগদান করতে দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওই কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসনেই ন্যস্ত করা হয়।

প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার এ ধরনের বিধিবহির্ভূত আচরণে ক্ষুব্ধ তার মন্ত্রণালয়েরই সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা বলছেন, আপাদমস্তক ভদ্রলোক, একজন সিনিয়র ও বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এতটা দুঃসাহসী হওয়ার স্পর্ধা কোথা থেকে পেলেন এ কর্মকর্তা? তারা এটাও বিশ্বাস করতে চান না তিনি (সচিব) প্রধানমন্ত্রীর লোক। তার বাড়িও প্রধানমন্ত্রীর এলাকায় নয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কাজ করা ব্যক্তিও তিনি একা নন।

অথচ এ কার্যালয়ে শুধু কাজ করার সুবাদে নমিতা হালদার কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চলেন। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর স্বচ্ছ ও গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের উচিত চাকরিবিধি ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া।

নতুবা এ ধরনের দুঃসাহস প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যেও আগামীতে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে তা যে কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের জনকল্যাণে নেয়া অনেক পদক্ষেপ দীর্ঘসূত্রতার মুখে পড়বে। পাশাপাশি সরকারও ভাবমূর্তি সংকটের মুখোমুখি হবে।

এদিকে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোয় খোঁজ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে এ কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর অন্যতম অভিযোগের একটি হচ্ছে- রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর নতুন আবেদন অনুমোদন স্থগিত রাখা। এ বিষয়ে বিএমইটি থেকে সুপারিশ করার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে।

এতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও জনশক্তি রফতানিতে প্রতিযোগিতা বাড়ার মাধ্যমে পুরো কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে- এমন সুদূরপ্রসারী ভাবনা থেকে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসিও এ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় শুধু মন্ত্রীর সম্মতি থাকায় তা রুখতে গত আট মাস ধরে নতুন আবেদনগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আটকে রেখেছেন সচিব নমিতা হালদার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবেদনকারীদের কয়েকজন বলেন, ‘আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতির প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর জন্য বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠানোর পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড এখন থেকেই জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখলেও অসৎ উদ্দেশ্যে বর্তমান সচিব নতুন আবেদনের অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছেন।’ তারা বলেন, ‘নতুন লাইসেন্স দেয়া না হলে নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে না।

তাছাড়া এ অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকলে বারবার ঘুরেফিরে মুষ্টিমেয় দালাল চক্রের হাতেই জনশক্তি রফতানি বাজারটি জিম্মি হয়ে থাকবে। এর থেকে জনশক্তি রফতানির বাজারকে মুক্ত করতে মন্ত্রী এ বিষয়ে সদিচ্ছা দেখালেও নমিতা হালদার কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নতুন লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত বন্ধ করে রেখেছেন।’ আবেদনকারীদের অনেকেই এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় সংক্ষুব্ধ হয়ে সচিবের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, বর্তমানে প্রায় ৪০০ নতুন রিক্রুটিং এজেন্সির আবেদন জমা পড়েছে। অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে ১৪০০টি। কিন্তু এসব রিক্রুটিং এজেন্সির অনেকটির কার্যক্রমই এখন বন্ধ। সূত্রের আরও দাবি, এ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার পর এখন পর্যন্ত জনশক্তি রফতানির বাজার উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো কাজেই হাত দেননি বর্তমান সচিব। ফলে গত বছর জনশক্তি রফতানির অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ হলেও এবার তার ধারে-কাছেও পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

তবে দুবাইয়ের সঙ্গে লোক দেখানো একটি সমঝোতা চুক্তি তিনি সম্পন্ন করেছেন; যার প্ল্যাটফর্ম মন্ত্রী আগেই সম্পন্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু সেখানে মন্ত্রীপর্যায়ের আলোচনায় জনশক্তি রফতানিতে বিভিন্ন খাতে দক্ষ জনবল নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হলেও সচিব চুক্তি করার ক্ষেত্রে কেবল ড্রাইভার, দারোয়ান, পিয়ন, বডিগার্ড ও গৃহভৃত্য রফতানি চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন, যা এই বাজারে আগেই বহাল ছিল।

তাছাড়া নতুন বাজার খোঁজার ক্ষেত্রে কোনো সফরে মন্ত্রীকে নেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না সচিব। আবার রাষ্ট্রীয় কোনো কাজে মন্ত্রীর বিদেশ সফরও বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। গেলেও তিনি মন্ত্রীকে বিদায় জানানো কিংবা আসার পর দেখা করার মতো সৌজন্যবোধটুকুও দেখাতে চান না। তিনি (সচিব) বলে থাকেন, ‘আমার ওপর প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ রয়েছে। কাউকে ভক্তি করার দরকার আমার নেই।’

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার বলেন, আমার সম্পর্কে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও মনগড়া। এর কোনোটির সঙ্গেই আমার সম্পৃক্ততা নেই। কারা কেন এ ধরনের অভিযোগ আনল, সেটি আমার বোধগম্য নয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভালো কোনো নির্দেশনা প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও দেশের নাগরিক হিসেবে আমি নিজের কর্মস্থলে প্রতিপালনের চেষ্টা করলে সেটা দোষের কিছু নয়। এটা করলেই আমি প্রধানমন্ত্রীর লোক হয়ে যাব কেন?

একজন কর্মকর্তাকে নিজের মন্ত্রণালয়ে যোগদানের সুযোগ না দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জেনে-শুনে নিজ মন্ত্রণালয়ে খারাপ কোনো লোককে আমি আনতে চাই না। সচিব হিসেবে এটা আমি করতেই পারি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশ্নে মন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী।

সেখানে আমি একজন সচিব হয়ে তার মতো সম্মানিত মানুষের সঙ্গে বিরোধে জড়ানোর প্রশ্নই আসে না। বরং আমি চেষ্টা করি সব সময় তার ছায়াতলে থাকতে। তিনি বলেন, এ মন্ত্রণালয়ে আমি নতুন। কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান উন্নতি এক দিনে সম্ভব নয়। একার পক্ষেও সম্ভব নয়। সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন। চেষ্টা করছি পরিস্থিতি উন্নয়নের।

সৌজন্যে- যুগান্তর