Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাস

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
৮ জানুয়ারী ২০১৪:

বিশ্বের যেকোনো মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি থাকে। সমষ্টিগত প্রতিটি জাতির এহেন সংগ্রামের ইতিহাস ঘটনাবহুল, বহু মানুষের ত্যাগ এবং ভবিষ্যত্ স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সংগ্রাম এ দেশের মানুষের মনন, চিন্তা এবং সংগ্রামী কর্মেরই প্রতিফলন। এ সংগ্রামের সবই বাংলাদেশীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে। এ নিবন্ধে আমাদের অর্থনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহাসিক পটভূমি ও কিছু ঘটনার ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।

chardike-ad

sss_28235দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের আগস্টে এ উপমহাদেশকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তিটাই ছিল দুর্বল। ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড, স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতি, এমনকি ঐতিহাসিক যোগসূত্র বিবেচনা করে বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মিল ছিল না মোটেও। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে দুটি আলাদা ভূখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্রতে পরিণত হলো, সেটার স্থায়িত্ব সম্পর্কে প্রথম দিক থেকেই অনেকের, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। ধর্মের যুক্তিতে কিন্তু ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অন্যান্য প্রদেশ ও ভূখণ্ড তদানীন্তন পাকিস্তানের অংশ হয়নি।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী সবারই ভাষা ছিল বাংলা। সংস্কৃতি, ইতিহাস সবই ছিল বাংলা ভাষাভিত্তিক। ধর্মে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান হলেও সব জনগণই কথা বলত বাংলায়। অতএব পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত এবং মূল ভিত্তিই ছিল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। তদানীন্তন পশ্চিম বাংলায়ও ছিল বাংলা ভাষার প্রচলন, কিন্তু সেই ভূখণ্ডের জনগণের মধ্যে কখনো বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেনি, তারা একাত্মতা অনুভব করত অখণ্ড ভারতের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সঙ্গে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইতিহাসের তাত্পর্যপূর্ণ কিছু ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। এ ঘটনাগুলো আমাদের নতুন করে স্মরণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে এগোতে হবে সেই ঘটনা পরম্পরার সঙ্গেই যোগসূত্র রক্ষা করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু এক বা একাধিক ঘটনা এবং মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক নেতার প্রয়াসের ফলই নয়। বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন স্তর ও পেশার ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাই বিভিন্ন সময়ে জাতির মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং ব্যবসায়ী, যারা বহুলাংশেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের লোক; তারা ১৯৪৭-এর পর থেকেই বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে একেবারেই অমনোযোগী ছিল। এমনকি তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের শোষণ করার পথই বেছে নিয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণ তাই প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছিল, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে পরিণত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়।

১৯৪৭-এর পর বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিক কেন্দ্রীয় সরকারের (পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত) বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানান এবং পদক্ষেপ নেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন নতুন রাজনৈতিক দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ১৯৪৯ সালের জুনে এ দলের ১২ দফা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনার একটি ভিত্তি রচিত হয়। ১২ দফায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সুনির্দিষ্ট দাবি ছিল, বিশেষ করে দফা ২ এবং ৩-এ স্বায়ত্তশাসন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির দিকটি বেশি প্রাধান্য পায়।

পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালে ১১ অক্টোবর ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বিশাল জনসভা হয়। এখানেই বাঙালির প্রতি অবিচার, অর্থনৈতিক শোষণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ১৯৫৩ সালে ডিসেম্বরে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় পূর্ববাংলার (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিগুলো আরো দানা বাঁধে। মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইলে কাগমারী সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা হয়। পরবর্তীতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির গঠনতন্ত্রে দলের লক্ষ্য ও আদর্শ বিধৃত করা হয় ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে। সেখানেও প্রাধান্য পায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। উপরোক্ত ঘটনাপ্রবাহে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সব নেতা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতাই সংশ্লিষ্ট ছিলেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অধিকারকে সমর্থন করতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, ওলি আহাদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আতাউর রহমান খানসহ বহু নেতাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমাদের ভাষা আন্দোলন, যা ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারিতে একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছায়, তারও ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি। এ আন্দোলনে এ দেশের বহু রাজনীতিক, ছাত্রনেতা ও জনসাধারণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর বাংলাদেশীদের মনে এই প্রত্যয় জন্মায় যে, তদানীন্তন পাকিস্তানের রূপরেখায় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বঞ্চিত, অবহেলিত এবং অপাঙেক্তয়। তারপর থেকে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম হয়ে ওঠে আরো জোরদার। শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফা হলো একটি মাইলফলক, যা ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়। এ ছয় দফা হয়ে ওঠে আমাদের স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের মূল প্লাটফর্ম। এ কথা উল্লেখ করতে হবে যে, ছয় দফার দাবিগুলো কিন্তু উঠে আসে অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও আমাদের শোষণের প্রতিবাদের ফসল হিসেবেই। পূর্বের সব ঘটনাপ্রবাহ এবং আন্দোলন ছয় দফা দাবির মূল শক্তি এবং উত্স। ছয় দফা দাবি পেশ করার পরই নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকারের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ। ১৯৬৮ সালে জানুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য কয়েকজন বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে শুরু হয় ‘আগরতলা মামলা’।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান এবং সেই সঙ্গে পেশ করা হয় ১১ দফা দাবি। ১৯৬৯-এর ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। বিভিন্ন স্থানে নিহত হন আরো অনেকে। মূলত ১১ দফা দাবি ছিল ছাত্রসমাজের আন্দোলনের দাবি এবং সে সময় ছাত্ররা নেতৃত্ব দেন সার্বিক আন্দোলনে, যেখানে জনসাধারণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু এক বা একাধিক ঘটনা এবং এক বা একাধিক ব্যক্তিরই প্রচেষ্টা নয়। আমাদের সংগ্রাম বহু ঘটনাপ্রবাহে গেঁথে আছে, যেখানে বহু ব্যক্তিরই অবদান রয়েছে।

১১ দফা দাবির ভিত্তিতে শুরু হয় ‘জ্বালাও-পোড়াও-ঘেরাও’ আন্দোলন এবং যেখানে মওলানা ভাসানীর জ্বালাময়ী বিভিন্ন বক্তব্য, শক্ত অবস্থান আন্দোলনকে করে আরো মজবুত। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য ব্যক্তিরা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। তারপর থেকেই স্বাধিকার আন্দোলন হয়ে ওঠে আরো দুর্বার, আরো ব্যাপক। ১৯৬৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চিয়রায় কৃষক সমিতির সভায় মওলানা ভাসানী বক্তব্য রাখেন; যেখানে তিনি কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের দুঃখ, বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন, প্রতিকার দাবি করেন।
সব ঘটনাপ্রবাহ এবং কর্মসূচি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, অর্থনৈতিক শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশী জনগণ পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই প্রতিবাদ করে এবং এর মুক্তির জন্য পথ খোঁজে।

মওলানা ভাসানী একবার দুঃখ করে উল্লেখ করেছিলেন, ১৯৫৬-৫৭ অর্থবছরে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ৪৮০ কোটি টাকা। এ চিত্র শুধু একটি বছরের নয়, এটি একটি উদাহরণ মাত্র। ছয় দফা দাবি পেশ করার আগে বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য (Disparity) সম্পর্কে অনেক তথ্য এবং বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাট রফতানি ছিল পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উত্স। কিন্তু সেই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে অতি সামান্য। পাকিস্তান যে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করত, তার সিংহভাগই ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধ হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাট রফতানির অর্থে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে আহরিত অন্যান্য সম্পদ থেকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে। সব মিলিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের মোট দেশীয় আয় (Gross regional Product) ছিল অনেক কম। ব্যক্তি খাতে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় থেকে অনেক বেশি।

পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ হওয়ার পর গত ৪০ বছরে অর্থনৈতিক মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা এক ধাপ অতিক্রম করেছি। সত্যিকার অর্থনৈতিক মুক্তি (যা রাজনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত) অর্জনে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে আরো অনেক চ্যালেঞ্জ। অতি দ্রুত সময়ে দেশপ্রেম, দৃঢ়তা, সততা নিয়ে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, এর বিকল্প নেই। এখনই সময় সবার এগিয়ে আসার।

লেখক: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
সূত্রঃ বণিকবার্তা।