
ফাইল ছবি
এক বছর আগে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় রায়ের পর খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেও আপিল করেই জামিনে তার বেরিয়ে আসার আশায় ছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু তা ঘটেনি, উপরন্তু আরেকটি মামলায় সাজার রায় এসে গেছে এর মধ্যে: আরও মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোয় আটকে গেছে মুক্তি; অংশ নিতে পারেননি একাদশ সংসদ নির্বাচনেও। এই অবস্থার মধ্যে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে এক বছর কেটে গেল সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার।
দলীয় চেয়ারপারসনকে যে এতদিন বন্দি থাকতে হবে, তা তখন ‘কল্পনাই করতে পারেননি’ বলে বৃহস্পতিবারই এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য আসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদের কাছ থেকে।
তিনি বলেন, “কোনো দিন কল্পনা করতে পারি নাই যে বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় নেত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে একটা তুচ্ছ ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দেবে। পাঁচ বছরের সাজায় আপিল ফাইল করার পর সাত দিনের বেশি উনার জেলখানায় থাকার কথা নয়।”
৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়ার বন্দি থাকা নতুন নয়। ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়ে এক বছর সাত দিন বন্দি ছিলেন তিনি। তখন তাকে রাখা হয়েছিল সংসদ ভবনের একটি বাড়িতে। তবে সেবারের বন্দিদশার সঙ্গে এবারের পার্থক্য হচ্ছে এখন তিনি বন্দি আছেন দুর্নীতির দায়ে দোষি সাব্যস্ত হয়ে। তখন যে মামলাগুলোর হয়েছিল, তার একটি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা।
এতিমদের জন্য আসা দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালে করা এই মামলায় ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে দোষি সাব্যস্ত করে ৫ বছরের সাজা দিয়ে রায় দেন ঢাকার জজ জজ মো. আখতারুজ্জামান। রায়ের পর ওই দিনই নাজিমউদ্দিন সড়কের ওই কারাগারে নেওয়া হয় ৭৩ বছর বয়সী খালেদা জিয়াকে।
পুরনো ওই কারাগারে তাকে নেওয়ার পর তখনই প্রশ্ন তুলেছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য কারাগারে সুবন্দোবস্তু করার কথা বলা হয়; এমনকি সেবার জন্য গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে কারাগারে রাখতে পারার নজিরবিহীন সুযোগ পাওয়ার কথাও বলে সরকার।

ফাইল ছবি
এই মামলায় খালেদা আপিল করে কয়েক মাস পর জামিন পেলেও তার মুক্তি আটকে যায় অন্য বিভিন্ন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোতে, যা তাকে আটকে রাখার ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ তোলে বিএনপি।
এর মধ্যেই ২৯ অক্টোবর হয়ে যায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়; এবার একই জজ মো. আখতারুজ্জামান এই দুর্নীতির মামলায় খালেদাকে দেন সাত বছরের সাজা।
তার একদিনের মধ্যে জিয়া এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় আপিলের রায় আসে হাই কোর্ট থেকে। খালেদা জিয়ার বয়স ও অবস্থান বিবেচনায় নিম্ন আদালতের বিচারকে আখতারুজ্জামান তাকে কম সাজা দিলেও তাতে সায় দেয়নি হাই কোর্ট।
বিএনপি চেয়ারপারসনের সাজা ১০ বছর বাড়িয়ে হাই কোর্ট বলে, “ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে (খালেদা জিয়াকে) সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কারণ সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ করার ক্ষেত্রে যাতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়।”
কারাগারে এই এক বছর খালেদার চিকিৎসা নিয়ে নানা নাটকীয়তা ছিল আলোচনায়। শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে যেতে আপত্তি করলেও পরে তিনি সেখানেই থেকে কিছু দিন চিকিৎসা নেন।
তাকে দুই বার চিকিৎসার জন্য বিএসএমএমইউতে নেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য গত এপ্রিলে। দ্বিতীয়বার নিয়ে ৬ অক্টোবর ৮ নভেম্বর তাকে রাখা হয়েছিল। পরে ফিরিয়ে নেওয়া হয় কারাগারে। এরপর অন্য মামলার বিচারে তাকে ওই কারাগারে স্থাপিত আদালতে তাকে দেখা গেছে হুইল চেয়ারে।
শরীর খারাপ হলেও খালেদার মনোবল অটুট দেখার কথা বলেছেন তার আইনজীবী মওদুদ। “এই সপ্তাহে দেখা হয়েছে উনার সাথে। উনার শরীর খুবই নরম হয়ে গেছে, কিন্তু মনোবল খুবই শক্ত। উনি হাঁটতে একেবারেই পারেন না এখন। পা মাটিতে রাখা সম্ভবপর হয় না বলে হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন।”
এই এক বছরে খালেদা জিয়ার ভাই-বোনসহ স্বজন এবং বিএনপি নেতারা দেখা করছেন তার সঙ্গে। তারা বলছেন, বিশাল ওই পুরনো কারাগারে ভুতুড়ে পরিবেশে বন্দি আছেন তাদের নেত্রী।
এক স্বজন বলেন, “কারাগারে তিনি (খালেদা জিয়া) একেবারেই ভালো নেই। অসুস্থতার মধ্যেই তার সময় কাটে বই ও পত্রিকা পড়ে। নিয়মিত কোরান শরিফও পড়েন তিনি। বেশিরভাগ সময় যুদ্ধ করতে হয় যন্ত্রণাদায়ক রোগ-ব্যধির সাথে।”
কারাগারের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়া চুপচাপই থাকেন সব সময়। কিছু লাগবে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রয়োজন হলে’ জানাবেন।
কারাগরেই খালেদা জিয়ার খাবার রান্না করা হয়। বাসা থেকে কোনো খাবার কারাগারে নিতে দেওয়া হয় না। শুধু দুই ঈদের বাসার রান্না করা খাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কারাগারে নিতে দেওয়া হয়েছিল।
কারাগারে জেল সুপারের কক্ষটিকে সংস্কারের পর ‘স্পেশাল জেল’ ঘোষণা করে সেখানেই খালেদাকে প্রথম দিন রাখা হয়েছিল। কয়েকদিন পর দোতলার একটি কক্ষে স্থানান্তর করা হয় তাকে, যা আগে কারাগারে ‘ডে কেয়ার সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহার হত।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের ভাষায়, সেই কক্ষটির অবস্থাও ভালো নয়। জরাজীর্ণ ও স্যাঁত স্যাঁতে অবস্থা।
“এখানে এত বড় বড় ইঁদুর দৌড়ায়, এতগুলো বেড়াল ওখানে, যারা ইঁদুর ধরে। আপনারা শুনলে হতবাক হবেন যে, ম্যাডামের ঘরের মধ্যে ওই বেড়াল বড় ইঁদুর ধরেছে,” গত বছর বলেছিলেন তিনি।
স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ এক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। এরপর এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ‘৮৪ সালের ৩ মে ও ‘৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিন দফায় বন্দি হয়েছিলেন তিনি। তবে তখন ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল তাকে।
তার ২০ বছর পর বন্দি হলেও তিনি ছিলেন সংসদ ভবনের মতো স্থানে একটি বাড়িতে। কারাগারের কুঠুরীতে এবারই প্রথম গেলেন তিনি। দুটি মামলায় রায় হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও অন্তত ৩৪টি মামলা রয়েছে বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে নাইকো মামলা, গ্যাটকো মামলা, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলার বিচার চলছে। এগুলো দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত।
বাকি মামলাগুলো রাষ্ট্রবিরোধী ও অপরাধজনিত মামলা। যানবাহনের আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, নাশকতা, ভুয়া জন্মদিন পালন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটুক্তির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলা। এর মধ্যে ২৬টি মামলা হয়েছে ঢাকায়। এছাড়া কুমিল্লায় তিনটি, পঞ্চগড় ও নড়াইলে একটি করে মামলা রয়েছে।
খালেদা জিয়া বন্দি থাকায় তার গুলশানের বাড়ি ‘ফিরোজা’ এখন জনশূন্য। নিরাপত্তাকর্মীরা নিয়মিত পাহারা দেন বাড়িটি। বাড়ির ভেতরের আঙিনা আগের মতোই দেখা গেছে, বাগানও রয়েছে ঠিক-ঠাক। ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমাই মূলত বাসাটি দেখাশোনা করেন।
খালেদা জিয়ার নামে এখনও যে চিঠি তার গুলশানের কার্যালয়ে আসে তা খোলা হয় না বলে দলটির নেতারা জানান। এইসব চিঠির মধ্যে রয়েছে- ঢাকার বিদেশি দূতাবাসগুলোর রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের শুভেচ্ছাপত্র। এছাড়া দলের তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীরাও চিঠি লেখেছেন তাকে।
চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, গত এক বছরে নয়শ’র বেশি চিঠি জমা হয়েছে। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর আইনি লড়াই চালিয়েই তাকে মুক্ত করার কথা বলেছিলেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু এখন তারা হতাশ।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে কয়েকদফা আন্দোলন করেও সফল না হওয়া বিএনপির নেতারা মনে করছেন, আন্দোলন ছাড়া তাদের নেত্রীকে মুক্ত করার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
খালেদার কারাবাসের বছর পূর্তির আগের দিনের অনুষ্ঠানেই মওদুদ বলেন, “যেহেতু আদালতের মাধ্যমে সম্ভবপর হচ্ছে না, সেজন্য আন্দোলন আমাদের করতেই হবে।”
সৌজন্যে- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম







































