অবশেষে ধরা দিয়েছে অধরা স্বপ্নের ট্রফি। এর আগে ছয় ছয়টি ফাইনাল খেলে প্রতিটিতেই হারের বেদনায় সিক্ত হতে হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। ‘লাকি সেভেন’ অর্থাৎ সপ্তম ফাইনালে এসে সেই ‘গেরো’ খুলতে পেরেছে টাইগাররা।
শুক্রবার রাতে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ফাইনালে দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সহজেই ৫ উইকেট হারিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ডাবলিনের দ্য ভিলেজের ম্যালাহাইড ক্রিকেট ক্লাব মাঠে বৃষ্টিবিঘিত ফাইনালে টস জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কিন্তু ক্যারিবীয়রা ২০.১ ওভারে বিনা উইকেটে ১৩১ রান করার পর বৃষ্টির বাধায় ম্যাচ বন্ধ হয়ে যায়। লম্বা সময় অপেক্ষার পর একপর্যায়ে ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার শঙ্কা জেগেছিল। সেটি হলেও গ্রুপ পর্বে বেশি পয়েন্ট পাওয়ার সুবাদে চ্যাম্পিয়ন হতো বাংলাদেশ।
কিন্তু অনেক অপেক্ষার পর ফের ম্যাচ মাঠে গড়ায় বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাতে ১০টা ৩০ মিনিটে। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় দুদল খেলবে ২৪ ওভার করে। ক্যারিবীয়রা আগেই ২০.১ ওভার খেলায় বাকি ৩.৫ ওভার খেলতে ফের ব্যাটিংয়ে নামে। শেষ পর্যন্ত পুনঃনির্ধারিত ২৪ ওভারে উইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১ উইকেটে ১৫২ রান। এরপর বৃষ্টি আইন ডার্কওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১০ রান। লক্ষ্যপূরণ করতে হবে সেই ২৪ ওভারেই। ইতিহাস গড়ার পথে দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার দুর্দান্ত সূচনা এনে দেন। এরপর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের দুরন্ত ব্যাটিংয়ে ২২.৫ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ইতিহাস গড়া জয়ের বন্দরে (২১৩ রান) পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। দুর্দান্ত এই জয়ে বিশ্বকাপে ভাল করার মন্ত্রও পেয়ে গেছে টিম বাংলাদেশ।
চোট পাওয়া বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই দুর্দান্ত এই জয়ে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বাংলার বিজয়ী বীরদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইতিহাস গড়া জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে উড়ন্ত সূচনা করে বাংলাদেশ। দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের চোখ ধাঁধানো সূচনার পর ৫.৩ ওভারেই তারা গড়ে ফেলেন ৫৯ রানের জুটি। ১৩ বলে ১৮ রান করে আউট হয়ে যান তামিম ইকবাল। তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন সাব্বির রহমান। কিন্তু যে কারণে তাকে আগে নামানো হয়, সেটা কাজে লাগেনি। শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে কোন রান না করেই সাজঘরে ফেরেন সাব্বির। এরপর মুশফিকুর রহীমকে নিয়ে সৌম্য সরকার আরেকটি কার্যকরী জুটি গড়ে তোলেন। এ দুজনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে জয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে টাইগাররা। কিন্তু দলীয় ১০৯ রানে সৌম্য ব্যক্তিগত ৬৬ রান করে ফিরলে কিছুটা চাপে পড়ে মাশরাফি বাহিনী। আরেকটা দারুণ ইনিংস সৌম্য সাজান নয় চার ও তিন ছয়ে। খেলেন মাত্র ৪১ বল। চাপটা আরও বাড়ে খানিক বাদে মুশফিক ৩৬ রান করে আউট হয়ে গেলে। এ সময় বাংলাদেশের রান ছিল ১৪ ওভারে ৪ উইকেটে ১৩৪। এরপর উইকেটে মাহমুদুল্লাহর সঙ্গী হন মোহাম্মদ মিথুন।
মিথুন ১৭ রান করে সাজঘরে ফিরলে মোসাদ্দেককে নিয়ে বাকি কাজটুকু সারেন মাহমুদুল্লাহ। সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে এসে অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক সৈকতই মূলত বাংলাদেশকে দুর্দান্ত জয় উপহার দেন। মাত্র ২৪ বলে দুই চার ও পাঁচ ছক্কায় ৫২ রানে অপরাজিত থাকেন সৈকত। দুর্দান্ত এই ইনিংসের মধ্য দিয়ে সাকিবের অভাব ভালমতোই মিটিয়ে দেন তিনি। সৈকত ও মাহমুদুল্লাহ অবিচ্ছিন্ন থেকে ২২.৫ ওভারে বাংলাদেশকে জয় উপহার দেন। লক্ষ্যমাত্রা ২১০ রান হলেও বাংলাদেশ করে ২১৩ রান। সময়োপযোগী বিস্ফোরক ব্যাটিং করে ফাইনালে ম্যাচ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের তারকা অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক হোসনে সৈকত।
এর আগে উইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়ে বোলিংয়ের শুরুটা ভালই করেন বাংলাদেশের বোলাররা। প্রথম ৫ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলতে পারে মাত্র ১৫ রান, বাউন্ডারি ছিল একটি। এ সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষাও ছিল দেখার মতো। সাইফ উদ্দিনের করা ষষ্ঠ ওভারে আমব্রিসের তিন বাউন্ডারিতে চিত্র বদলানোর শুরু। সাইফকেই পরে চোখ ধাঁধানো ফ্লিকে ছক্কা হাকান হোপ। দুই দলের আগের লড়াইয়ের ম্যাচ সেরা মুস্তাফিজুর রহমানকে একাদশ ওভারে আক্রমণে আনেন অধিনায়ক। আমব্রিস ফিজকে স্বাগত জানান আবারও ওভারে তিন বাউন্ডারিতে। ক্রমে বাড়তে থাকে ক্যারিবিয়ানদের রানের গতি। ৫০ বলে ফিফটি স্পর্শ করেন হোপ, ৬০ বলে আমব্রিস। বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডারদের যখন মনে হচ্ছিল অসহায়, ক্যারিবিয়ানদের তখন থামায় বৃষ্টি। এরপর থেকেই অপেক্ষা। কখনও থামে, কখনও নামে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়ে শেষ পর্যন্ত ফের মাঠে গড়ায় খেলা।
পুনরায় খেলা শুরুর পর একমাত্র উইকেটটি হারায় ক্যারিবীয়রা। মেহেদি হাসান মিরাজকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানায় ধরা পড়েন হোপ। অর্থাৎ বাকি ৩.৫ ওভারে ২১ মাত্র রান যোগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবমিলিয়ে ২৪ ওভারে ১ উইকেটে তাদের হয় ১৫২ রান। উইন্ডিজের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ৭৪ রান করেন শাই হোপ। ৬৯ রানে অপরাজিত থাকেন সুনিল আমব্রিস। চার ওভারে ২২ রান খরচায় বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র উইকেটটি কব্জা করেন মিরাজ।
উল্লেখ্য, এর আগে বাংলাদেশ ছয়টি ফাইনালে হার মানে। এগুলো হলো ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার কাছে, ২০১২ সালে এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে, ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে টি-২০ এশিয়া কাপে ভারতের কাছে। ২০১৮ সালটা সবচেয়ে বেদনার বাংলাদেশের কাছে। এ বছর তিন তিনটি ফাইনালে হারে লাল-সবুজের দেশ। প্রথমে দেশের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে, এরপর শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফিতে ভারতের কাছে এবং সবশেষে আবুধাবিতে এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বেদনায় লাল হতে হয় বাংলাদেশকে। এক বছর বাদে এবার আয়ারল্যান্ডে অধরা ট্রফির দেখা পেয়েছে টাইগাররা।
‘লাকি সেভেন’কে সার্থক পরিণতি দিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য, এর আগে বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দল দেশের ক্রিকেটকে প্রথম ট্রফি উপহার দেন এশিয়া কাপ জিতে। প্রমীলাদের পর এবার প্রথমবারের মতো পুরুষ দল ট্রফি জয়ের স্বাদ পেল।