মাত্র তিন বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ১০৬ লাল মোহনদাস লেনে মমতাজ ভিলা নামে ১০তলা বাড়ি। ভবনটির পুরোটাই ব্যবহার করছেন দুই ভাই এনু ও রুপন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় দুই ভাই রাজকীয়ভাবে থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেয়া হয় না। এর মধ্যে কয়েকটি ফ্ল্যাটে থাকেন এনু-রুপনের আত্মীয়স্বজনেরা। তারা মূলত দুই ভাইয়ের সহযোগী হিসেবেই কাজ করেন। গতকাল পর্যন্ত র্যাব এই দুই ভাইকে আটক করতে পারেনি। ক্যাসিনোর টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন এনু ও রুপন। গেন্ডারিয়া ও নারিন্দা এলাকায় ৩০টির বেশি বাড়ির মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এনামুল ও রুপন। এলাকাবাসীর মুখেও উঠে এলো তাদের অপকর্মের বিভিন্ন অভিযোগ। তারা অবৈধ অস্ত্রের হুমকি দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকলেও নগদ কোটি কোটি টাকায় পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, বংশাল, ইসলামপুর, কোতোয়ালি এলাকায় এই দুই ভাই জুয়ার টাকা দিয়ে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন। সেগুলোর সন্ধান করছে র্যাব।
সূত্রাপুরের বানিয়ানগরের ৩১ নম্বর বাড়িতে এনু-রুপন কেউ থাকেন না। ছয়তলা ভবনটিতে থাকেন তাদের আত্মীয়স্বজনেরা। এই ভবনের দ্বিতীয় ও পঞ্চম তলায় এনামুল হক এনুর শ্যালক ও শাশুড়ি থাকেন। এই বাড়িরই দ্বিতীয় একটি ও তৃতীয় তলায় দু’টি ভল্ট পাওয়া গেছে। এই দুই ফ্ল্যাটেই পাওয়া যায় ৭৩০ ভরি স্বর্ণ। এনুর সহযোগী আবুল কালাম ওরফে কালার বাসায় একটি সিন্দুক পাওয়া গেছে; যার মালিক এনু। এর থেকে দুই কোটি টাকা, একটি অবৈধ অস্ত্র ও ১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, কালা দীর্ঘ দিন ধরে ওয়ারির টিপু সুলতান রোডে লেদ মেশিনের দোকান করতেন। সেখান থেকে হঠাৎ করে দোকান বাদ দিয়ে মতিঝিলের কোথায় যেন চাকরি নেন। এনু ও রুপনের কর্মচারী এই কালা। বিশ্বস্ত কর্মচারী হওয়ায় কালার বাসায় রাখা হয় একটি সিন্দুক।
স্থানীয় বাসিন্দা সেকেন্দার আলী জানান, ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ওয়ান্ডার্স ক্লাব ও রুপন আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলতেন। একটা সময় তারা জুয়ার বোর্ডের মালিক বনে যান। সেখান থেকে আসতে থাকে কাঁচা টাকা। সেই টাকাতেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন এনু-রুপন। গেন্ডারিয়ার মোহন দাস লেনের বানিয়ানগরের বাড়িটি দেড় বছর আগে হারুনুর রশীদ নামে একজনের কাছ থেকে তারা কিনেছেন। জুয়ার বোর্ড থেকে যে টাকা আসত, সেই টাকার একটি অংশ এনু ও রুপন বাসাতেই রাখতেন।
এ দিকে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও তার ভাই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার রাতে তিনটি মামলা করেছে র্যাব। সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়া থানায় করা মামলায় এনামুল হক এনু, রূপণ ভূঁইয়া, তার বন্ধু জাকির ও কর্মচারী আবুল কালাম আজাদকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার তিনটি অভিযানে ওয়ার্ডারার্স ক্লাবের অংশীদার এনু ও রুপন এবং তাদের দুই সহযোগীর বাসা থেকে ৫ কোটি টাকা, ৮ কেজি স্বর্ণ ও ৬টি অস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব। মানিলন্ডারিং ও অস্ত্র আইনে এসব মমালা দায়ের করা হয়।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কে এম শফিউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, অভিযানের পর মামলার জন্য অনেক কাগজপত্র তৈরি করতে হয়। আমাদের টিমের সদস্যরা এ কাজে ব্যস্ত ছিল। পাশাপাশি আমরা রুপনসহ যারাই এর সাথে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে তালিকা : অভিযান চলবে সারা দেশে : অবৈধ ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলবে সারা দেশে। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা সারা দেশের ক্লাবগুলোর তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ঢাকায় একের পর এক ক্লাব থেকে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান ও এর সাথে রাঘব বোয়ালদের জড়িত থাকার ঘটনায় সারা দেশে এ রকম অবৈধ ক্যাসিনো রয়েছে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনার ক্লাবপাড়ায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
এ দিকে ক্যাসিনোর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার মামলার তদন্তভার র্যাবকে দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক মামলার তদন্ত করছিল মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যায় মামলা দু’টির তদন্তভার ডিবির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এসব মামলায় খালেদ সাত দিনের পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এএসপি মিজানুর রহমান জানান, খালেদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলা দু’টির তদন্ত করবে র্যাব। ওই মামলাগুলোর নথিপত্র র্যাব ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছে।
এর আগে গুলশান থানায় দায়েরকৃত দুই মামলায় সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের পর তদন্তভার পায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এত দিন মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়েই চলছিল তার জিজ্ঞাসাবাদ। আগামীকাল শুক্রবার তার রিমান্ড শেষ হওয়ার কথা ছিল। অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনার দায়ে গ্রেফতার খালেদের বিরুদ্ধে গুলশান ও মতিঝিল থানায় চারটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে গুলশান থানায় অস্ত্র, মাদক ও মানিলন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা এবং মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে আরো একটি মাদকের মামলা করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ক্লাবের ক্যাসিনোতে বছরের পর বছর ধরে নিপুণ, চড়চড়ি, ডায়েস, ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, রেমি, ফ্ল্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের তাস খেলা বা কথিত ইনডোর গেমসের নামে জুয়া খেলা চলছে। এসব ক্লাবে ক্যাসিনোর নামে শুধু জুয়া খেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, পাশাপাশি অবাধে মাদক বেচাকেনা ও নারীদের নিয়ে অশ্লীলতা চলছে।
ঢাকায় ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া চক্র ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে অভিযানে ক্যাসিনোর সন্ধান এবং বিপুল টাকা, অস্ত্র উদ্ধারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়।
সূত্র জানায়, রাজধানীর বাইরের ক্লাবগুলোর তালিকা সংগ্রহ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে রয়েছেÑ নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় বর্ণালী সংসদ, বগুড়ার রহমান নগর ক্রিকেট ক্লাব, চাঁদপুরের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভাই ভাই স্পোর্টিং ক্লাব, ফ্রিডম ফাইটার (৫ নম্বর গুপ্তি ইউনিয়ন পরিষদ), নোয়াখালীর শহীদ শাহ আলম স্মৃতি সংসদ হলরুম, সোনাইমুড়ী, বরিশালের সেতুবন্ধন ক্লাব ও লাইব্রেরি, ও চট্টগ্রামের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের নাম। একই সাথে এসব ক্লাবের নামে যারা কোটি কোটি টাকা আয় করছে সেসব ব্যক্তিদেরও তালিকা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।