Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তিনির্ভর বিপণন বিপ্লব

korean-shopবিশ্ব অর্থনীতিকে এক প্রকার থমকে দিয়েছে করোনা নামের নতুন ঘাতক ভাইরাস। বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে অস্থিরতার মধ্যে। যার প্রভাব পড়ছে আক্রান্ত দেশগুলোর বাজার ব্যবস্থার উপর। হু হু করে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। কিন্তু, এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম দক্ষিণ কোরিয়া। এখানে সবকিছুর দাম স্বাভাবিক। জিনিসপত্রের সঙ্কট যেমন দেখা দেয়নি, দামও বাড়েনি।

দক্ষিণ কোরিয়ায় সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পেছনের মূল কারণ তাদের সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট কৌশল ও প্রযুক্তির (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার। একইসঙ্গে দেশটির নাগরিকদের মূল্যবোধ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

chardike-ad

করোনা মহামারিতে তথ্য কেন্দ্রীভূতকরণের মাধ্যমে নানা উৎস থেকে পাওয়া তথ্য তাদের সাপ্লাইচেইন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাকে সচল ও স্বাভাবিক রেখেছে। কোরিয়ার এই কৌশলকে ইন্টিগ্রেটেড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট বলা হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

১) গবেষণা: কোরিয়ার সরকার মোট জনসংখ্যা, তাদের চাহিদা, নতুন পণ্য ও নতুন ব্যবসা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করে। যেটাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (বিপিআর) বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদন, বিপণন, ভোক্তার চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধার দিকগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যার পুরোটাই করা হয় প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এতে ভোক্তা, ভোক্তার খাদ্যভাস, ক্রয় ক্ষমতা, উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম নিপুণভাবে সম্পন্ন করা হয়। তথ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। সরকার নিয়ন্ত্রিত ডাটা ওয়্যার হাউস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করে।

২) চাহিদা ও যোগান: ভোক্তার চাহিদা ও যোগানের তথ্য পাওয়া যায় গবেষণা বা বিপিআর থেকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই তথ্য পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক চাহিদা আর যোগানের আনুমানিক একটি ধারণা দিয়ে থাকে।

৩) সোর্সিং বা প্রক্রিওরমেন্ট: গবেষণা থেকে পাওয়া চাহিদা ও যোগানের তথ্যের ভিত্তিতে উৎপাদনের উৎস বা ক্রয় ব্যবস্থাপনার সমন্বয় করা হয়। যেটাকে সোর্সিং বা প্রক্রিওরমেন্ট মডিউল বলা হয়। অর্থাৎ কোন কোন উৎস থেকে ভোক্তার প্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

৪) উৎপাদন ব্যবস্থাপনা: বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) এর মাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান করতে শুরু করেছে। তবে, কয়েক বছর ধরেই সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন তথ্য সরকারের এজেন্সির মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ন্ত্রিত তথ্য ব্যাংকে চলে যায়। এর মাধ্যমে প্রতিদিনের উৎপাদন বিষয়ে সরকার জানতে পারে এবং পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

কোরিয়ার কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে এ্যাগ্রো কো-অপারেটিভভিত্তিক ব্যাংক ও সাধারণ ব্যাংক জড়িত। ফলে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সারাদেশের কৃষকদের তথ্যের বিশাল উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। এগুলো কৃষিপণ্যের বিপণনের সঙ্গেও জড়িত।

৫) লজিস্টিক: উৎপাদনের পরে আসে পরিবহণ ও বিতরণ ব্যবস্থা। যেমন, একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্য স্টক বা মজুত করা। এ সম্পর্কিত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা অন্য কোনো মাধ্যমে সেন্ট্রাল ডাটাওয়্যার হাউজে জমা হয়। যাকে লজিস্টিক বলা হয়।

৬) বিপণন: সরকারি গবেষণা বিভাগের তথ্যের উপর ভিত্তি করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তা নেওয়া হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী পণ্যের দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে মার্কেটিং বিভাগের কেনো পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই ভোক্তার সীমাবদ্ধতার বিষয়কে বিবেচনা করা হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রতিটি ধাপে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ, সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা, আর্থিক সেবাখাত, সরকারি ট্যাক্স/ভ্যাট দপ্তর, পণ্যের যোগান, সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়, বিক্রয়কেন্দ্র সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টিগ্রেটেড ডেটা সিস্টেম। উৎপাদন, পরিবহন, লজিস্টিক ধাপ সরকারের বিপণন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করলেও কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত থাকে। ফলে সরকারি সংস্থা পুরো প্রক্রিয়াটি সহজে গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

করোনা মহামারিতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তথ্য বিশ্লেষণ ও অ্যাপের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়োজিত সংস্থা তথ্য পেয়ে থাকে। ফলে তারা যে কোনো পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে পারে। এসব কারণেই মহামারি পরিস্থিতিতেও দক্ষিণ কোরিয়াতে ভোগ্যপণ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সহজে পাওয়া যাচ্ছে।

শেষ কথা, গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনো কোরিয়ান নাগরিককে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা চেইন শপ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ্যপণ্য কিনতে দেখা যায়নি। কোরিয়ার নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ায় সরকারের পক্ষেও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।

এমএন ইসলাম, সিউল থেকে