দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের দল। কোভিড-নাইনটিন মহামারি মোকাবেলায় সাফল্যের কারণে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ প্রশংসিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারের এই সাফল্যই দেশের ভেতরে প্রেসিডেন্ট মুনের জন্যে এনে দিয়েছে বড় রকমের রাজনৈতিক বিজয়।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো নিরাপত্তা মূলক কিছু কঠোর ব্যবস্থার মধ্যেই দেশটিতে বুধবার এই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখনও অবধি গণণা করা ভোটের হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট মুনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ৩০০ আসনের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ১৬৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। এই দলটিরই আরেকটি সহযোগী সংগঠন প্ল্যাটফর্ম পার্টি আরো ১৭টি আসনে জয়ী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই হিসেবে পার্লামন্টে সরকারের মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮০।
মোট ৩৫টি দল এই নির্বাচনে অংশ নেয় তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও রক্ষণশীল বিরোধী দল ইউনাইটেড ফিউচার পার্টির মধ্যে। দক্ষিণ কোরিয়ায় গত ১৬ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বামপন্থী দলগুলো এরকম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। কিন্তু মাত্র কিছু দিন আগেও প্রেসিডেন্ট মুন সরকারের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ভাটা পড়েছিল।
গত জানুয়ারি মাসেও ধারণা করা যায়নি যে নির্বাচনে বর্তমান সরকারি দল এভাবে জয়লাভ করবে। দেশটির অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছিল, স্থবির হয়ে পড়েছিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শন্তি আলোচনা, সেটা কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিল না, বেকারত্ব নিয়েও সরকারের সমালোচনা হচ্ছিল প্রচুর।
এছাড়াও দেশটির সংবাদপত্রগুলো ছেপে ছিল একের পর এক রাজনৈতিক ও প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট মিত্রদের কেলেঙ্কারির ঘটনায়। এসবই ছিল রাজনৈতিক প্রচারণার ইস্যু। কিন্তু পরে করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে সবকিছু। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, এই অবস্থা থেকে প্রেসিডেন্ট মুনের দলকে উদ্ধার করেছে করোনাভাইরাস।
ট্রেসিং ও টেস্টিং: ভাইরাসটি যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য বিলম্ব না করেই কঠোর কিছু পদক্ষেপ নেয় মুন জে-ইন সরকার। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাজার হাজার নমুনা পরীক্ষা, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের খুঁজে বের করে তাদের আলাদা করে রাখা এবং বিদেশ থেকে যারা এসেছে তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা লরা বিকার বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট মুনের সরকার যে যুদ্ধংদেহী পদক্ষেপ নিয়েছিল সেগুলো তার দলের অবস্থাকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।
তিনি লিখেছেন, “ট্রেসিং ও টেস্টিং এর মাধ্যমে দেশটি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফল হয়েছে। যেখানে দেশটিতে এক সময় প্রতিদিন সংক্রমণের সংখ্যা ৯০০তে পৌঁছে গিয়েছিল সেই সংখ্যা তারা ৩০টিরও নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়।”
দক্ষিণ কোরিয়াই প্রথম দেশ যারা এর সংক্রমণ কমিয়ে খুব দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। প্রেসিডেন্ট মুনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই বিষয়টিকেই তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মুখ্য ইস্যু করে তোলেন।
বিরোধী দল ইউনাইটেড ফিউচার পার্টিও হাসপাতালের ফ্রন্টলাইনে কর্মরত হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশংসা করে। এর ফল হিসেবে তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে পার্লামেন্টে বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এই নির্বাচনকে দেখা হচ্ছিল প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের জনপ্রিয়তার ওপর মধ্যবর্তী গণভোট হিসেবেও।
সিউল-ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইং কোরিয়ার প্রধান পার্ক সি- ইয়ং নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, “সরকার করোনাভাইরাসকে যেভাবে মোকাবেলা করেছে সেটাই সবকিছু বদলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার পেছনে এটাই ছিল মূল কারণ।”
মানুষ যেভাবে ভোট দিল: করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনেকেই আশঙ্কা করেছিল যে এবারের নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সেরকম কিছু হওয়া তো দূরের কথা বরং এবার রেকর্ড সংখ্যায় ভোট পড়েছে। ভোট দেওয়ার আগে ভোটারদের স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হয়েছে। মুখে পরতে হয়েছে মাস্ক ও হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস।
ভোটারদেরকে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে। এসময় তাদের তাপমাত্রাও মেপে দেখা হয়েছে। তারপরেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যালট পেপার। যাদের তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ছিল তাদেরকে আলাদা একটি বুথে গিয়ে ভোট দিতে হয়েছে। সেখানে প্রত্যেক ভোটার ভোট দেওয়ার পর প্রতিবারই বুথটি ধুয়ে মুছে জীবাণুমক্ত করা হয়েছে।
একজন নারী ভোটার বিবিসিকে বলেছেন, “আমি ভেবেছিলাম ভোট হয়তো স্থগিত করা হবে। কারণ লোকজন যে ভোট দিতে আসবে সেটা আমি ভাবিনি।” “কিন্তু ভোট দিতে এসে দেখলাম আমার মতো আরো অনেকেই ভোট দিচ্ছেন। আমি আর চিন্তিত নই।”
‘দক্ষিণ কোরীয় মডেল’: দক্ষিণ কোরিয়াতে বর্তমানে ৬০ হাজার লোক কোয়ারেন্টিনে রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৬৬ শতাংশ যা গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশ শুক্র ও শনিবারে কোয়ারেন্টিন স্টেশনগুলোতে স্থাপিত বুথে গিয়ে অথবা পোস্টের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন।
তবে যারা কোভিড-নাইনটিন রোগী তাদেরকে পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে অথবা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্ধারিত ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোট দিতে হয়েছে। তাদের গণ-পরিবহন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। তারা হয় হেঁটে, নয় নিজেদের গাড়িতে করে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
একটি শহরের মেয়র বলেছেন, “সবাই পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল। তাই তারা অভিযোগ না করে বরং এসব ব্যবস্থার প্রশংসাই করেছে।” করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর শুরুর দিকে অল্প কিছু সময়ের জন্যে দক্ষিণ কোরিয়াতে পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিয়েছিল।
তবে সরকার ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়ে ও যারা যারা আক্রান্ত লোকের সংস্পর্শে এসেছে তাদেরকে শনাক্ত করার মাধ্যমে পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। সরকারের এসব ব্যবস্থা পরিচিতি পায় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় “দক্ষিণ কোরীয় মডেল” হিসেবে।
সৌজন্যে- বিবিসি বাংলা