
কে কখন কোন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বসবেন, এমন একটা আশঙ্কা নিয়ে ঢাকার মানুষকে এখন চলাচল করতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যানারে ব্যস্ত সড়কে হাজির হচ্ছেন কেউ না কেউ। যাঁরা সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন, তাঁদের বেশির ভাগ নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বা ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করছেন।
কেউ সুনির্দিষ্ট ‘ব্যানার’ নিয়ে আন্দোলন করছেন, আবার কেউ ব্যানার ছাড়াই হঠাৎ সড়কে নেমে বিক্ষোভ করছেন। যেমন গত ২৬ আগস্ট সকালে হঠাৎ শাহবাগ এলাকার সড়ক অবরোধ করেন প্যাডেলচালিত শত শত রিকশাচালক। তাঁদের দাবি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ঢাকার সড়কে চলতে পারবে না।
সেদিন শাহবাগের পাশাপাশি ঢাকার আরও কিছু এলাকার সড়কে নেমেছিলেন প্যাডেলচালিত রিকশাচালকেরা। তবে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় নামলেও সুনির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের ব্যানারে তাঁরা সেদিন জড়ো হননি। যে যাঁর মতো করে এলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে পারবে না ঢাকায়, এটিই ছিল মূল দাবি।
এ ঘটনার আড়াই মাস পর গত ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের এক নির্দেশনার বিরোধিতা করে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনে নামেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা। তাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সড়ক অবরোধ করে শুরু করেন আন্দোলন। ওই আন্দোলনের মধ্যে ২১ নভেম্বর ঢাকার মহাখালীতে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকেরা অবশ্য সফল হয়েছেন। রাজধানী ঢাকার মূল সড়কগুলো বাদে অলিগলির সড়কে চলাচলের অনুমতি আদায় করতে পেরেছেন তাঁরা। যদিও মূল সড়কেও এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা যাচ্ছে।
সড়ক অবরোধের ঘটনা গতকাল রোববারও ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। দুপুরের দিকে হঠাৎ মগবাজার মোড়ের কাছে অফিসার্স ক্লাব–সংলগ্ন প্রধান সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা জেলায় (রাজধানীর বাইরে) চলাচলের নিবন্ধন পাওয়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকেরা। এতে দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
অবরোধকারীদের দাবি, ঢাকা জেলায় চলাচলের জন্য নিবন্ধিত অটোরিকশাও রাজধানীর সড়কে চলাচলের সুযোগ দিতে হবে। প্রায় এক ঘণ্টা অবরোধের পর সড়ক ছেড়ে যান তাঁরা। ঢাকা জেলা সিএনজি অটোরিকশা মালিক-শ্রমিক কল্যাণ সোসাইটির ব্যানারে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একের পর এক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক দাবিতে অনেক পেশাজীবী সংগঠন, শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ-আন্দোলন করায় ঢাকার যানজট আরও তীব্র হচ্ছে, মানুষের ভোগান্তি-কষ্ট বাড়ছে। সরকারি কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে।
ছোট-বড় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত গত ৫ মাসে অন্তত ১০১টি আন্দোলনের তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো। এর মধ্যে অনেক সংগঠন ও গোষ্ঠীর আন্দোলন এখনো চলমান। এমন অনেক সংগঠনের ব্যানারেও আন্দোলন হচ্ছে, যেসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। শুধু দাবি জানানোর জন্য বেশ কিছু সংগঠনের জন্ম হয়েছে। আবার কেউ কেউ কোনো ব্যানার বা সংগঠন ছাড়াই আন্দোলনে নেমেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল একবারে নাজুক। বিপর্যস্ত অবস্থায় দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যখন কিছুটা গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, তখন একের পর এক যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলন শুরু হওয়ায় সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতি এখনো আছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রথম দিকে আন্দোলনকারীরা নানা দাবি নিয়ে জড়ো হতেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) সামনে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের আরেকটি ‘পছন্দের’ জায়গা হয়ে ওঠে শাহবাগ। নিষেধাজ্ঞার কারণে যমুনার সামনে এখন কেউ কর্মসূচি পালন করতে না পারায় শাহবাগের ওপর ‘চাপ’ বেড়েছে। এর আগে কখনো কখনো যমুনার সামনে একসঙ্গে পাঁচ-ছয়টি সংগঠনও নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দিনে ১৪-১৫টি সংগঠনও রাজপথে নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। যেমন ১৯ আগস্ট ঢাকার বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে অন্তত ১৭টি সংগঠন। কারও দাবি চাকরি স্থায়ীকরণ, কেউ চায় দুর্নীতি রোধ, কেউবা বৈষম্যের ‘শিকার’, আবার কেউ ‘বঞ্চিত’ দাবি করে সেদিন সড়কে নেমেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। উত্তরা, শাহবাগ, মিরপুর রোড, প্রেসক্লাব, সচিবালয়, রামপুরা, কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক আটকে সেদিন বিক্ষোভ করা হয়েছিল। এর মধ্যে যমুনার সামনে সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেছিলেন ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের নারীরা। সেদিন নানা আন্দোলনকারীর ভিড়ে বিডিআর থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যদের একটি দল প্রেসক্লাবের সামনে জায়গা না পেয়ে এর বিপরীত পাশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
এমন পরিস্থিতিতে ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সবার সহযোগিতা চেয়ে বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া, লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসংগতভাবে যা কিছু করার, আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের ঘেরাও করে কাজে বাধা দেবেন না।’
প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের পরও সড়ক আটকে আন্দোলন বন্ধ হয়নি। এখন যেসব আন্দোলন চলমান, এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুটি দল রয়েছে। এই দুটি দল আবার মুখোমুখি অবস্থানে আছে। একটি দলে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। অন্য দলে আছেন প্রশাসন বাদে অন্য ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ নামে ২৫ ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা উপসচিব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল, নিজ নিজ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া এবং সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছেন।
































