আমদানি চাহিদা কমে যাওয়া ও ওভারডিউ এলসি (ঋণপত্র) পেমেন্টের চাপ থাকাসহ নানা কারণে ২০২৫ সালের প্রথম মাসে আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির হার দুটোই আগের বছরের একই মাসের তুলনায় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৬.১৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৫.৪ শতাংশ কম।
জানুয়ারিতে আমদানি এলসি খোলা কেন কমেছে, জানতে চাইলে অন্তত তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন আগের তুলনায় এলসি খোলার চাহিদা কমে আসছে। এর একটা বড় কারণ, মূল্যস্ফীতির কারণে সামগ্রিক চাহিদা কমে যাওয়া, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কাঁচামালের চাহিদা আগের তুলনায় কমে যাওয়া।
তবে বেশ কিছু দুর্বল ব্যাংক আছে, যাদের আমদানি এলসি খোলার সক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ওভারডিউ পেমেন্ট পরিশোধ করার চাপে রয়েছে, ফলে তারা নতুন করে এলসি খুলছে না। আবার কিছু ব্যাংক এমনও আছে, যাদের এলসি খোলার সক্ষমতা থাকলেও খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি এলসি খোলা হয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলারের—যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২.৬৩ শতাংশ বা ১ বিলিয়ন ডলার বেশি।
ব্যাংক এশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে থেকে আমদানি এলসি খোলার চাহিদা কিছুটা কম দেখছি। বিশেষ করে রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এলসি খোলার চাহিদা গত বছরের তুলনায় কম বলে মনে হচ্ছে।’
তবে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও রমজান মাসের পণ্যের আমদানি এলসি খোলা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজারে চাহিদা কম আছে বলে আমদানিকারকরা আমদানিও কমিয়ে দিচ্ছেন।
খাতভিত্তিক আমদানি এলসি খোলার চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে সবচেয়ে বেশি ৩৪ শতাংশ এলসি খোলা কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে।
এই সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯.৭৩ শতাংশ এলসি খোলা কমেছে পেট্রোলিয়াম আমদানিতে।
শিল্পের কাঁচামাল ভোগ্যপণ্য ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানিই আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি অনেকদিন ধরেই কমছে। এটি ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়ার মানে হলো, শিল্পগুলো এখন উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগী নয়।
‘ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে প্রভাব ফেলছে এই প্রবণতা। যন্ত্রপাতি আমদানি কমায় এটা বোঝা যাচ্ছে, শিল্পগুলো তাদের সক্ষমতা সম্প্রসারণ করছে না।’
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি দীর্ঘসময় ধরে কম থাকলে সেটি অর্থনীতিকে শ্লথ করে দেয় মন্তব্য করে এই অভিজ্ঞ ব্যাংকার বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য গত কয়েক মাসে কিছুটা ভালো হয়েছে। তবে সার্বিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম পাচ্ছেন।’
জানুয়ারিতে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১ শতাংশ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জানুয়ারিতে ৫.৯৩ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।
অবশ্য অর্থবছরের হিসাবে আমদানি এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আমদানি এলসি পেমেন্ট করা হয়েছে ৪০.২৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় শেষে এলসি পেমেন্ট করা হয়েছিল ৩৯.৪৩ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে আমদানি এলসি খোলা ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ফলে একই ধারাবাহিকতায় এলসি পেমেন্টও কমে এসেছে।
খাতভিত্তিক আমদানি এলসি পেমেন্টের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ২৭ শতাংশ এলসি পেমেন্ট কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মধ্যর্বর্তী পণ্য আমদানি পেমেন্ট কমেছে ১৩ শতাংশ।
অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে শিল্পের কাঁচামাল ছাড়া অধিকাংশ পণ্যের আমদানি পেমেন্ট কমেছে।
ব্যাংক খাতে ডেফার্ড এলসির পরিমাণ কমে আসায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পেমেন্টের চাপ কম মন্তব্য করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা এখন পেমেন্ট শিডিউল করে এলসি খুলছি। ফলে আমাদের ডেফার্ড পেমেন্টের চাপ কমে গেছে।’
রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি এলসিসহ অধিকাংশ পণ্যের ডেফার্ড এলসি খোলায় এখন চাপ কম পড়ছে মন্তব্য করে সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, ‘বেসরকারি ব্যাংকগুলো বেশ আগে থেকেই পেমেন্ট শিডিউল করে ডলার ম্যানেজ করে রাখায় বর্তমানে পেমেন্টের চাপ খুব বেশি নেই।’