আজকের ব্যস্ত জীবন যেন আমাদের এক ‘চিরদৌড়’-এর যাত্রী বানিয়ে ফেলেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিত্যকার দৌড়ঝাঁপ, একের পর এক কাজ, ই-মেইল আর মেসেজের ভিড়ে আমরা যেন একটি অবিরাম অফিস প্রতিযোগিতায় আটকে গেছি।
কিন্তু এই দৌড়ে আমরা অনেকেই টের পাই না, কখন যেন আমাদের মানসিক শক্তি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, আর আবেগগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থার ধারাবাহিকতায় দেখা দিতে পারে বার্নআউট বা মানসিক অবসাদ। তাই সময় থাকতে নিজের ক্লান্তি ও চাপে থাকার লক্ষণগুলো চেনা এবং তা মোকাবিলা করা খুব জরুরি।
পূর্ণকালীন চাকরি হোক, ফ্রিল্যান্সিং কিংবা হাইব্রিড ওয়ার্ক – সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আজকের কর্মজীবীরা কাজের ভারে যেন হিমশিম খাচ্ছেন। আমরা নিজেরাও কখন যে কাজ আনন্দ, বিশ্রাম ও সৃজনশীলতাকে গ্রাস করে নিয়েছে, তা বুঝে উঠতে পারি না।
এই কারণেই এখন সময় সচেতন হওয়ার। আসুন জেনে নিই এমন কিছু লক্ষণ, যেগুলো বুঝিয়ে দেয় আপনি কাজের অতিরিক্ত চাপে রয়েছেন – আর সেইসঙ্গে জেনে নিই কীভাবে আপনি নিজেকে সামলে নিতে পারেন এই পরিস্থিতিতে।
১. আপনি কি ‘প্রোক্রাস্টিনেশন’ বা দীর্ঘসূত্রিতায় আক্রান্ত?
একটা কাজ শেষ না হতেই আরেকটা এসে পড়ে। এতসব কাজের ভিড়ে মাথা ঝিমঝিম করে। ঠিক কখন কী কাজ শুরু করবেন বুঝে উঠতে না পেরে আপনি হয়তো কাজ না করেই সময় নষ্ট করছেন। সোশ্যাল মিডিয়া, খবর, অথবা জানালার পাশে বসে পাখি দেখা যেন হয়ে উঠছে আপনার দৈনন্দিন কাজের বিকল্প। তার অর্থ আপনি প্রোক্রাস্টিনেশনের ফাঁদে পড়েছেন। এটি কাজের চাপ জমে পাহাড় হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ।
সমাধান: কাজের তালিকাটা ছোট করুন। একবারে হাতে বেশি কিছু রাখবেন না। কিছু কাজ পিছিয়ে দিন, কিছু কাজ ভাগ করে দিন। নিজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত একটি সময় ব্যবস্থাপনার কৌশল খুঁজে নিন এবং দিনে-দিনে সেটি বাস্তবায়ন করুন।
২. আপনি কি অফিসের ‘হ্যাঁ মানুষ’ হয়ে উঠেছেন?
সবাই জানে, আপনি সবসময়ই ‘হ্যাঁ’ বলবেন। ফলে সব কাজ এসে পড়ে আপনার কাঁধে। এতে প্রথমদিকে বাহবা পেলেও, পরবর্তীতে এর চাপে আপনি নিজেই ডুবে যেতে পারেন।
সমাধান: নিজেকে প্রশ্ন করুন – এই কাজটি কি আমার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যদি না হয়, বিনয়ের সঙ্গে `না’ বলতে শিখুন। প্রতিদিনের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাজের সীমা নির্ধারণ করুন এবং সেই সীমা মেনে চলুন।
৩. আপনার অফিসের সময় কি শেষ হয় না কখনোই?
সপ্তাহান্তেও আপনি কাজ করছেন? ছুটির দিনে ই-মেইল চেক করছেন? এমন হলে বুঝে নিন, কাজ আপনার জীবনের ব্যালান্স নষ্ট করে দিচ্ছে। মনে রাখবেন, পেশাগত কাজ আপনার জীবনের অংশ। কাজই জীবন নয়।
সমাধান: নিজের কাজের সময় ও ব্যক্তিগত সময়ের মধ্যে পরিষ্কার একটি সীমারেখা টানুন। প্রয়োজন হলে বস বা ক্লায়েন্টের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন। অনেক সময় এটি নিজেই বুঝিয়ে দেয়, কোথায় গলদ হচ্ছে – আপনার অকার্যকর টাইম ম্যানেজমেন্ট, না কি আসলেই কাজের চাপ অতিরিক্ত।
৪. সপ্তাহের শুরু মানেই আপনার বিষণ্নতা
সপ্তাহ শুরু হলেই কি আপনার বুক ধড়ফড় করতে থাকে? মনে হয়, আরেকটা সপ্তাহ কী করে পার করব? তাহলে ধরে নিন, আপনার ভেতরকার সতর্ক সংকেত বাজতে শুরু করেছে।
সমাধান: আপনার কাজের পরিবেশ, দায়িত্ববোধ, বা এমনকি পেশাটিই হয়তো আপনার সঙ্গে মানানসই নয়। এক্ষেত্রে হয়তো পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, অথবা সাহস করে বিশ্রাম নিতে হবে। প্রয়োজনে বড় কোনো পরিবর্তনের কথাও ভাবতে পারেন।
৫. শেষ কবে ছুটি নিয়েছেন, মনে নেই?
একটানা কাজ করে যেতে যেতে হয়তো আপনি ভুলেই গেছেন অবকাশ বা ছুটির মানে কী! অথচ নিয়মিত ছোট ছোট ছুটিই আমাদের কর্মক্ষমতা ধরে রাখে, মানসিকভাবে তরতাজা রাখে।
সমাধান: সপ্তাহে অন্তত একটি দিন নিজের জন্য নির্দিষ্ট করুন। সাপ্তাহিক ছুটির পরিকল্পনা করুন, এমনকি তা ঘরে বসেই হোক না কেন। সময় পেলেই ঘুরে আসুন আশপাশে কোথাও। এবং বছরে অন্তত একবার দীর্ঘ একটি ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা করুন।
৬. সমস্যা স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছেন?
অতিরিক্ত কাজের চাপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা হতে হবে আপনাকেই। নিজের সময়, সীমা ও মানসিক শান্তির জন্য নিজেই দায়িত্ব নিন। সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা গড়ে তুলুন, নিজের জন্য স্পষ্ট সীমারেখা তৈরি করুন।
সব চেষ্টা করেও যদি কাজের পরিবেশে পরিবর্তন না আসে, তাহলে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নতুন চাকরি বা নতুন পথের কথা বিবেচনা করা সময়ের দাবি। মনে রাখবেন জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যে কাজের প্রয়োজন, সেই কাজ যদি জীবনটাকেই গিলে খায়, তাহলে বদল দরকার। কারণ, আপনার স্বাস্থ্যের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নয়।