বুধবার । ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
নিয়াজ মাহমুদ সাকিব ফিচার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৫:৫৪ অপরাহ্ন
শেয়ার

চা এবং কফি: সহস্র শতাব্দীর স্বাদ ও সম্পর্কের সেতু


Tea Coffe

চায়ের ইতিহাস যেন পাতার ভেতরে লুকোনো সভ্যতা। “এক কাপ চা মানেই শান্তি-বিশ্রাম, এক কাপ চা মানেই গল্পের শুরু, শুরু নতুন সম্পর্কের।”

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, চীনের সম্রাট শেন নং- হঠাৎ একদিন দলবল নিয়ে ভ্রমণে বেরোলেন। আর সবুজ ঘেরা রাস্তায় কৌতূহলবশত হাতের নাগালে পেলেন চা-পাতার খোঁজ। তাঁর সেই কৌতূহলের ফলাফলই ‘চা’। কৌতূহলবশত শেন নং যে চা চেখে দেখতে চেয়েছিলেন, তা আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব-জুড়ে, পরিণত হয়েছে আমাদের নিত্যদিনের অভ্যাসে।

Tea Coffe 2

ঔপনিবেশিক যুগে যে চা হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু, তা-ই আবার একটা পর্যায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এসে তৈরি করেছে এক অনন্য আঙ্গিকের আড্ডার-সংস্কৃতি। বাংলাদেশ বা ভারতের চায়ের দোকান মানেই এখনো রাজনীতি, হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব আর সম্পর্কের টানাপোড়েনের এক মিলনকেন্দ্র।

বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যার আড্ডা, অফিসের বিরতিতে কফি মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট আলাপ, কিংবা একাকী কোনো ভোরে জানালার ধারে বসে চা—সবখানেই মিশে আছে গল্প।

Tea Coffe 1
আর কফিও তো শুধু পানীয় নয়, চিন্তাশীল মানুষের জ্বালানি।”

কফির শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় ইথিওপিয়ার বুনো গুল্মে। প্রাথমিক পর্বে জনপ্রিয় হয় আরব দুনিয়ায়। এমন কথা প্রচলিত আছে যে, সুফি দরবেশরা রাতভর জিকির করার শক্তি পেতেন কফি থেকে। ষোড়শ শতক নাগাদ ইয়েমেন ও মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে কফির জয়জয়কার, এবং তারপর ঢুকে পড়ে ইউরোপে।

সপ্তদশ (১৭শ) শতকের লন্ডন ও প্যারিসের কফি হাউসগুলোকে ইতিহাসবিদেরা বলেন “এক পেনির বিশ্ববিদ্যালয়”—কারণ এখানে এক পেনির বিনিময়েই পাওয়া যেতো কফি আর কফি কিনে বসা যেতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অলস বিকেলের সময় যেন নিমেষেই কেটে যেতো আর সঙ্গে চলতো রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বাণিজ্য পর্যন্ত নানান রঙ্গের নানান ঢঙ্গের আলোচনার প্রস্ফুটিত বাহার।
এক পেনিতেই কফি আর মুক্ত মতবিনিময়।

Tea Coffe 5

উল্লেখ্য, অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বীজও বপিত হয়েছে সেসব আড্ডায়। একেকটা কফি হাউজ যেন একেকটি দুর্গ। গণতন্ত্রকামীদের আলোচনার পীঠস্থান। কথিত আছে,গণতন্ত্রের প্রথম বীজও অঙ্কুরিত হয়েছিল এরকমই কোনো এক কফিশপেই।

কফির ঔপনিবেশিক বিস্তার আর বৈশ্বিক যাত্রার উপাখ্যান কিছুটা অবাক করবার মতোই। ১৬০০ সালের পর ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কফিকে ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে—ইন্দোনেশিয়ার জাভা, ব্রাজিল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল প্ল্যান্টেশন। শ্রম, দাসপ্রথা আর বাণিজ্য—সব মিলিয়ে কফি হয়ে ওঠে বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি মূল উপাদান।
তবে এর পেছনে কালোদের উপরে হওয়া কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন কিছু নির্মমতার পরিহাসের গল্পও রয়েছে বৈকি!

কফির উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে এটি প্রথম পান করা হয়েছিল আরব বিশ্বে, তবে ১৫০০ সালের আগে এর তেমন কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। তবে ইথিওপিয়ার বুনো গুল্ম থেকে কফি সংগ্রহ করা হতো—এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে। ষোড়শ শতকের শুরুতে ব্যবসায়ীরা কফি কিনতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে এটি পানীয় হিসেবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

১৫২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে কফিকে চিকিৎসায় ব্যবহার করার অনুমোদন দেন সেখানকার রাজ-চিকিৎসক। এরপর ইয়েমেনে কফি গাছ চাষ শুরু হয় এবং ইয়েমেনই গোটা আফ্রিকা ও আরব দুনিয়ার প্রধান কফি-উৎপাদক অঞ্চল হয়ে ওঠে এবং শতবর্ষব্যাপী সরবরাহ অব্যাহত রাখে ।

সে সময়টাতে ঘরে কেউ কফি পান করতো না; বরং মানুষ একত্র হতো কফি হাউসে এসে। সেখানে চা–কফি মূলত গৌণ উপজীব্যই, এবং সবকিছু ছাপিয়ে মূল উপজীব্য হয়ে উঠতো আলাপ, বিতর্ক তথা মতবিনিময় । ফলতই, সামাজিক জীবনে বিশাল প্রভাব পরে কফির । তবে ক্ষমতাসীনরা এই প্রভাবকে প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবেও দেখা শুরু করে একটা সময়।

Tea Coffe 6

১৬২৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের শাসক সব কফি হাউস ধ্বংসের আদেশ দিয়েছিলেন। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর নতুন কফি হাউস গড়ে ওঠে এবং কফি পান অব্যাহত থাকে। কফি হাউস এর প্রাণ-চঞ্চলতা কখনোই আদতে আকর্ষণ হারায়নি।

সপ্তদশ শতকে কফি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও কফি হাউস সাধারণ মানুষকে (মূলত পুরুষদের) একত্র হওয়ার, মতবিনিময় করার ও সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ দেয়। অনেকেই বলতেন, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কাজ করছে। আসলে, অনেক সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক বিকাশের শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় সে কফি হাউসগুলোর আলোচনায়।

১৬০০ সালের শেষ দিকে ইয়েমেনের একাধিপত্য ভেঙে যায় এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি কফি উৎপাদনকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। ইন্দোনেশিয়া ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে কফি প্ল্যান্টেশন গড়ে তোলা হয়। এর ফলে উৎপাদন দ্রুত বেড়ে যায়।

কফির ধরনগুলোর নাম অনেক সময় বন্দর থেকে নেওয়া হতো, যেখান থেকে সেগুলো ইউরোপে পাঠানো হতো—যেমন মক্কা (Mocha) বা জাভা (Java)।

ব্রাজিল ও ক্যারিবিয়ান কলোনি: বিশাল প্ল্যান্টেশনে কফি উৎপাদন হতো, যেখানে শ্রমিকরা প্রায় সবাই দাস ছিল।
ইন্দোনেশিয়ার জাভা (ডাচ কলোনি): কৃষকেরা নিজেরা কফি উৎপাদন করতো এবং নির্দিষ্ট অংশ ডাচদের দিত—এটি কার্যত কর ব্যবস্থার অংশ ছিল।

কিন্তু যে পদ্ধতিই ব্যবহার করা হোক না কেন, আঠারো শতকে কফি উৎপাদন ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল। ইউরোপের বাড়তে থাকা চাহিদা মেটাতে কফি উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং চিনি উৎপাদনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চিনিও যেমন প্রয়োজনীয়, কফিও যেন ঠিক তেমনিভাবেই অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠছিলো।

Tea Coffe 7

তবে দাম তখনো এতটা কমেনি যে মানুষ ঘরে বসে নিয়মিত কফি খেতে পারবে; তাই কফি মূলত কফি হাউসেই খাওয়া হতো এবং এটি তখনও বিলাসপণ্যের মতোই ছিল।

এই সময়েই চীন থেকে ইউরোপে চা পৌঁছে যায়। ব্রিটেনে ধীরে ধীরে চা কফির জায়গা দখল করে নেয়, যদিও প্রথমে এটি এত ব্যয়বহুল ছিল যে কেবল উচ্চবিত্তরাই তা কিনতে পারতেন। কিন্তু ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পর তারা চা-কে ব্রিটেনের প্রতীক হিসেবে মেনে নিলো, আর কফি হয়ে উঠলো মার্কিনদের পছন্দের পানীয়—যা আজও সত্য।

উনবিংশ শতকে এসে কফি উৎপাদন আরও বাড়ে এবং দাম কমতে শুরু করে। এর বড় কারন ছিল পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি- নির্দিষ্ট করে বললে, সস্তা ও দ্রুততর পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা। ফলে, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও কফি কিনতে সক্ষম হওয়া শুরু করলো।

এই সময়েই ইউরোপের বহু মানুষ শিল্পবিপ্লবের অংশ হতে গিয়ে কারখানাগুলোতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন । এমনকি অনেক সময় রাতেও কাজ চালিয়ে যেতে হতো। ফলে, কফি কেবল সকালে পান করার মতো কিছু আর রইলো না; বরং হয়ে ওঠে কাজের শক্তি ও রাত জাগার সহায়ক পাথেয়।

বর্তমান বিশ্বে কফির রপ্তানিকারক দেশগুলোর কথা যদি খুঁজতে যান, তবে একেবারে সামনের সারিতেই পাবেন ব্রাজিলের নাম। আর তৎকালীন এই ব্রাজিল আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জীয় আঞ্চলিক বলয়ের দাস-দাসীদের অবদানেই আজকের এতো স্বাদের ব্ল্যাক কফি আর ডার্ক চকোলেট।

আঠারো শতকে ব্রিটেনে কফির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির হয় চা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাবে চা পৌঁছে যায় ভারত ও বাংলাদেশে, আর কফি হয়ে ওঠে আমেরিকার জাতীয় পানীয়।

উনবিংশ শতকে শিল্প-বিপ্লবের ছোঁয়ায় বদলে গেলো- শ্রম আর শ্রমিকের ধরণ, বদলেছে কারখানার রূপ, কিন্তু সেই আড্ডার চিরাচরিত রূপে কি সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো বদল এসেছিলো? জী, এসেছিলো। শ্রমিকরা কফিকে বেছে নিল রাত জাগার জ্বালানি হিসেবে, আবার চা হয়ে উঠলো কর্মজীবী শ্রেণির দৈনন্দিন সান্ত্বনা।

তখন থেকেই আলাপচারিতা দুই রূপ নিল—
চায়ের আড্ডা: সহজ, আন্তরিক, লোকালয়ের উষ্ণতায় ভরা।
কফির আড্ডা: শহুরে, বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈশ্বিক আলোচনার মঞ্চ।

আড্ডার ধরণ বদলেছে ঠিকই, কিন্তু টিকে গেছে আড্ডা আর আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চা আর কফি। পরিবর্তনের স্রোতে ম্লান হয়ে যায়নি, হারায়নি। আগেকার দিনে যেখানে কফি হাউস বা চায়ের দোকান ছিল মানুষের সমাবেশের কেন্দ্র, আজ সেখানে এসেছে ডিজিটাল আড্ডা। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, জুম মিটিং, বা ফেসবুক লাইভে হলেও পাশে থাকে সেই অপরিবর্তনীয় সঙ্গী—চা কিংবা কফি। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশকে এতোটাও ডিজিটাল গন্ডির ছাঁচে ফেলা যাবেনা নিশ্চয়ই। এখানে আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন সবকিছু ঠিকঠাকভাবে থাকলেও চায়ের দোকান রমরমা, তবে কফিশপগুলোতে কিছুটা পশ্চিমা প্রোডাক্টিভিটি ফ্রিকিশ কালচারের আবেশ পাওয়া যায়।

Tea Coffe 4

তবে সময় পাল্টালেও মূল গল্পটা একই।
মানুষ এখনো আড্ডায় মাতে, কথা বলে, মত বিনিময় করে। আর সেই কথোপকথনের পটভূমিতে প্রায়শই থাকে এক কাপ চা কিংবা কফি।

ICO এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন পৃথিবীতে ৩ বিলিয়নেরও বেশি কাপ কফি পান করি আমরা। এবং FAO বলছে, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন চা পান করেন। ভাবুন তো—এই দুই পানীয় ঘিরে প্রতিদিন গড়ে ওঠে কয়েক বিলিয়ন গল্প, হাসি, সম্পর্ক আর কতো মনের ভাব বিনিময়, প্রাণ জুড়ানো আলাপ আর সুখ-দুঃখের লেনদেন।

চা আর কফির এই গল্প কেন এভারগ্রীন (চিরকালীন) জানেন কি? সভ্যতা বদলায়, প্রযুক্তি এগোয়, মানুষের আড্ডার ধরণ বদলাতে থাকে, প্রেক্ষাপট বদলায়। তবু দিনের শেষে বন্ধু, পরিবার বা সহকর্মীর সঙ্গে— কখনো চায়ের কাপ হাতে, কখনো কফির ধোঁয়া ওঠা মগে—মানুষ এখনো খুঁজে ফেরে গল্পের উষ্ণতা আর সম্পর্কের বন্ধন। আর সেই বন্ধনের সাথী হয়ে থাকে চা আর কফি।

চা আর কফি তাই কেবল স্বাদের গল্প নয়; এগুলো হলো আলাপের অনন্ত ভাষা, সম্পর্কের অমর সেতু

চায়ের কাপ-কফির মগই আড্ডার অনন্ত ভাষা। আর চা আর কফি নয় শুধুই পানীয় । এগুলো সব স্মৃতির অ্যালবাম, সম্পর্কের সেতু, আর আড্ডার অবিনাশী ভাষা।