
যে রুটি আমরা ভাগ করি, সেটাই আমাদের পতাকা।– প্যালেস্টিনিয়ান কবি মাহমুদ দারবিশ
‘সুমুদ ফ্লোটিলা-২০২৫’ গাজার ক্ষুধার্ত- নিপীড়িত মানুষদের সঙ্গে হয়তো সেই রুটি সদৃশ পতাকাই ভাগ করতে গেছে।
“আমরা নৌকায় ভাসি, কিন্তু আমাদের গন্তব্য কেবল সমুদ্রের তীর নয়; আমাদের গন্তব্য ন্যায়বিচার।” — ফ্লোটিলা কর্মী
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু যাত্রা আছে, সেসব যাত্রার নাম শুনলেই যেন রণ-ডঙ্কা বাজে। তবে আবার এমন ও কিছু সমুদ্র যাত্রা আছে, যেখানে যাত্রা মানেই যুদ্ধযাত্রা নয়, যুদ্ধজাহাজের মতো ভয়ঙ্কর নয়, কিন্তু তবুও সেসব যাত্রা হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদীদের বুকে কাঁপন ধরানো ভয়ের প্রতীক, সেটলারদের ত্রাস। ফ্রিডম ফ্লোটিলা এমনই এক যাত্রা। সাধারণ সমুদ্রযাত্রা নয় বরং মানবতার ঘোষণাপত্র।
গাজা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ অবরোধ ও নিষ্পেষণের শিকার হওয়া অঞ্চলগুলোর একটি। জাতিসংঘের ২০২৩ এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ সালে সন্ত্রাসী দেশ ইসরায়েল নিষ্পাপ গাজাবাসীর উপর অবরোধ দিয়ে খুবই সুকৌশলে দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে অন্ধকার, ক্ষুধা ও ভয়াবহ মানবিক সংকটে ঠেলে দেয়। এই অবরোধ ভাঙতে, মানবতার পক্ষে দাঁড়াতে যে প্রতীকী আন্দোলন, যে নৌ-বহর আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তাই ফ্রিডম ফ্লোটিলা।
এই ফ্লোটিলা শুধু খাবার আর ওষুধ বহন করে না; বহন করে একটি রাজনৈতিক কবিতা, একটি মানবিক ঘোষণা—“আমরা প্যালেস্টাইনের পাশে আছি।”
২০০৮ থেকেই প্রতিরোধের পাল তোলে মানবতাবাদীরা।

২০০৭ এর অবরোধের পর গাজার বুকে প্রথম মানবিক সহায়তা পৌঁছায় ২০০৮ সালে, যখন আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংগঠন ছোট ছোট নৌকায় গাজায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয় (বিবিসি, ২০০৮)। এটাই প্রথম নৌ-যাত্রা, কিন্তু বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় ২০১০ সালের ফ্রিডম ফ্লোটিলা । ছয়টি জাহাজের বহরে ৬০০ জনের ও বেশি মানবাধিকারকর্মী ছিলেন। প্রধান জাহাজ মাভি মারমারা আন্তর্জাতিক জলসীমায়ই ইসরায়েলি নৌবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়, নিহত হন ৯ জন মানবাধিকারকর্মী এবং আহত হন শতাধিক (আল জাজিরা ২০১০)। এই নৃশংসতা বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়- গাজার অবরোধ শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই হত্যাযজ্ঞ তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ককে সংকটে ফেলে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি ওঠে।
ঘাসান কানাফানি একবার লিখেছিলেন
“প্যালেস্টাইনের সংগ্রাম কেবল প্যালেস্টাইনের নয়, এটি গোটা মানবতার।”
২০১০ সালের মাভি মারমারা সেই সত্যকেই নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছিল।
যে জাহাজে রুটি থাকে, সেই জাহাজই জাস্টিসের ঝান্ডা তুলে এগিয়ে যায়।” — মাহমুদ দারবিশ

এক নজরে ফ্লোটিলার টাইমলাইন
২০০৮: প্রথম মানবিক সহায়তা পৌঁছায় এবং ছোট ছোট নৌকাগুলো গাজায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
২০০৯: গাজার উপর ভয়াবহ ইসরায়েলি হামলার পর নতুন বহরের প্রস্তুতি নেয়া হয়।
২০১০ (ফ্রিডম ফ্লোটিলা I): মাভি মারমারা হত্যাযজ্ঞ। বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ ও ইসরায়েলের অবরোধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষোভ।
২০১১–২০১২( ফ্রিডম ফ্লোটিলা II) : একাধিক বহর গাজায় ঢোকার চেষ্টা করে কিন্তু প্রত্যেকটা বহরের সবাই আটক হয়।
২০১৫: “উইমেন’স বোট টু গাজা”—নারী নেতৃত্বাধীন ফ্লোটিলা আন্তর্জাতিকভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২০১১-১০১৫ পর্যন্ত আসলে একাধিক ছোট ছোট বহরই গাজায় প্রবেশের চেষ্টা করে। কাজের কাজ উল্লেখযোগ্য কিছু না হলেও ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সংহতি একটা পাওয়া ছিল বটে।
২০১৮: নরওয়ে ও সুইডেন থেকে যাত্রা শুরু করা বহর ইসরায়েল আটক করে (Middle East Monitor, 2018)।
২০২১–২০২২: করোনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় কার্যক্রম সীমিত হয়, তবে পুনর্গঠন চলতে থাকে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০২৩–২০২৪: গাজায় নির্বিচারে নির্মম“গণহত্যার” (এমিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০২৩) প্রতিবাদে নতুন করে করে আবার ফ্লোটিলার পরিকল্পনা হয়।

২০২৫ (ব্রেক দ্যা সিজ- কনশানস (ফ্লোটিলা)- প্রথম ফ্লোটিলা যাত্রা শুরু করে গ্রেটা থুনবারগের নেতৃত্বে। ইসরাইল তাকে আটক করে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
কিন্তু বিশ্বের মানবতাবাদীরা তো আর থেমে থাকার নয়। এরপর ৪৮ টি দেশ থেকে সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, আইনজীবী, বিজ্ঞানী সহ নানা মত-পেশার মানুষ শুরু করে “সুমুদ ফ্লোটিলা” যাত্রা। এবং সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সুমুদ ফ্লোটিলার সবকটি জাহাজ আটক করা হয়েছে। তবে নতুন করে আরো ১১ টি জাহাজ গাজার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে দৃক গ্যালারি ও পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী ও লেখক ড. শহিদুল আলম সুমুদ ফ্লোটিলা যাত্রায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

বাংলাদেশ থেকে আলোকচিত্রী ও লেখক ড. শহিদুল আলম বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন
২০২৩-২৪ সাল থেকেই গাজার পরিস্থিতি অসম্ভব রকমের বাজে রূপ নিতে শুরু করে। এহেন কোনো অত্যাচার নেই, যা গাজার মানুষদেরকে সহ্য করতে হয়নি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ৯০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, এবং শিশুদের ৮০% অপুষ্টিতে ভুগছে (UN OCHA, 2024)।
এই সময়ে ফ্রিডম ফ্লোটিলা আবারও আলোচনায় আসে। এই নৌযাত্রা যেন সফল হয়,কামনা গোটা বিশ্বেরই, কিন্তু নেহায়েত ফ্লোটিলা যাত্রীরাও জানে যে, তাঁদের হয়তো আটক হতে হবে, হয়তো জীবন ও যেতে পারে, হয়তো বা সফলতার দ্বারপ্রান্তে তো দূর, দূরপ্রান্ত ও ছুঁতে পারবে না তাঁরা, তবুও তাঁরা এগিয়ে যায় প্রতীকী প্রতিবাদে। প্রেশার গ্রুপ হয়ে দুদিনের নিস্তার মেলাতে পারলেও গাজাবাসীর উপকার। এ কথাও জানা যায় যে, পরিকল্পিতভাবে ক্ষুধার তাড়নায় হত্যার যে নীল নকশা ইসরাইল এঁটেছে, সে পরিকল্পনায় সমুদ্র সমান না হলেও এক টেবিল চামচ গুঁড়ে বালি নিশ্চয়ই পড়েছে। ফ্লোটিলার অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ইসরাইলি নেভির সৈন্যরা দুদিন ব্যস্ত থাকায়, সাধারণ গাজাবাসী দুদিন গাজার সমুদ্র তীরে মাছ ধরার সুযোগ পেয়েছিলো দুবেলা। ফ্লোটিলার ছোট এক বহরই যেন হয়ে ওঠে ইসরায়েলি দমননীতির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক বিবেকের কণ্ঠস্বর।

একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেছিলেন
“আমরা জানি হয়তো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব না। কিন্তু আমাদের নৌকা ভেসে বেড়ালে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন বেজে ওঠে এক একটি প্রতিরোধ আর প্রতিবাদের চিৎকার—প্যালেস্টাইনের জন্য।” যেন শুধু মানবিক সহায়তা নয়, বরং নীরব বিশ্বশক্তির বিরুদ্ধে উচ্চারণ—“আমরা দেখছি, আমরা নীরব নই।”
প্যালেস্টিনিয়ান কবি মাহমুদ দারবিশ লিখেছিলেন—
“আমরা ভালোবাসি জীবনকে, যদি জীবন আমাদের একটি পথ দেয়।” ফ্রিডম ফ্লোটিলা সেই পথেরই নাম।
প্রতিটি জাহাজ যেন একটি কবিতা; প্রতিটি পাল যেন মানবতার পতাকা।
যখন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে, তখন মনে হয়—
এই নৌকা শুধু খাদ্য নয়, প্রতিটি ঢেউ নিয়ে আসছে আশা, প্রতিটি যাত্রা লিখছে ইতিহাসের নতুন কবিতা।
তিনি আরো লিখেছিলেন- “যে রুটি আমরা ভাগ করি, সেটাই আমাদের পতাকা।”ফ্রিডম ফ্লোটিলা যেন সেই পতাকার মূর্ত প্রতীক। কর্মীরা জানেন, হয়তো তারা পৌঁছাতে পারবেন না; হয়তো গ্রেফতার বা নিহত হবেন। তবুও তারা রওনা দেন, কারণ প্রতিটি রুটির প্যাকেট, প্রতিটি ওষুধের বাক্সই হলো এক একটি কবিতা—প্রতিরোধের কবিতা, প্রতিবাদের কবিতা।

কেন আজও প্রাসঙ্গিক
গাজার শিশু যখন ক্ষুধায় কাঁদে, তখন নরওয়ের একজন শিক্ষক বা আয়ারল্যান্ডের একজন নার্স কিংবা হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশি শহিদুল আলম নিজের জীবন বাজি রেখে নৌকায়-জাহাজে চড়ে বসেন। কারণ ফ্রিডম ফ্লোটিলা কেবলই মানবিক সহায়তার নৌযান-বহর নয়, বিশ্ব বিবেককে ছুঁড়ে দেওয়া এক চ্যালেঞ্জ। ইসরায়েলের অবরোধ যতই শক্ত হোক, ছোট ছোট নৌকাগুলো বারবার উঠে আসে মানবতার ঢেউ হয়ে। বিশেষ আরো যেসব কারনে এখনও প্রাসঙ্গিক-
১. মানবিক দিক: গাজার শিশুরা এখনো ক্ষুধার্ত।
২. রাজনৈতিক দিক: অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী (International Criminal Court, 2021)।
৩. প্রতীকী দিক: ছোট ছোট জাহাজই বিশ্বশক্তিকে প্রশ্ন করে—“তোমরা কি চুপ থাকবে?”
ফ্রিডম ফ্লোটিলা আজ ইতিহাসের অংশ, আবার বর্তমানেরও লড়াই।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
“যদি বন্দুক ভয় দেখায়, যদি অবরোধ দেয়াল তোলে,
তবুও নৌকা ভাসে…
আর সেই নৌকায় ভেসে চলে মানুষের হৃদয়ের ন্যায্য দাবি—
প্যালেস্টাইনের মুক্তি।”
আজকের পৃথিবী হয়তো পরাশক্তির হাতে বন্দি, কিন্তু সমুদ্রপথে ভেসে চলা এই নৌযাত্রা প্রমাণ করে—
“বন্দুক মানুষকে ভয় দেখাতে পারে, কিন্তু মানুষের বিবেককে কখনো দমাতে পারে না।”
ফ্রিডম ফ্লোটিলা ইতিহাসে শুধু এক অধ্যায় নয়, বরং এক চলমান কাব্য—
যেখানে প্রতিটি পাল, প্রতিটি ঢেউ উচ্চারণ করে একটাই শব্দ—
“প্যালেস্টাইন মুক্ত হোক।”





































