বুধবার । ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ফিচার ৬ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৭ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

‘গয়ানাথের বালিশ’ থেকে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া নেত্রকোণার ‘বালিশ মিষ্টি’


Balish Misti Cover

‘জাম, রসগোল্লা পেয়ে শ্বশুর করলেন চটে নালিশ
আশা ছিল আনবে জামাই গয়ানাথের বালিশ।’

–নেত্রকোণা অঞ্চলে বহুল প্রচলিত এই ছড়াটি নেত্রকোণার ঐতিহ্যবাহী ‘বালিশ মিষ্টি’ নিয়ে

নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি এখন শুধু একটি জনপ্রিয় মিষ্টি নয় — এটি জেলাটির একটি আইকন। ২০২৫ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে জিআই (Geographical Indication) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি এবং মিষ্টিটির ইতিহাস, গুণাবলী ও সম্ভাবনা কতটা রয়েছে, তা তুলে ধরা হবে এই লেখায়।

জিআই পণ্য কী?
ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হলো এমন একটি সনদ বা স্বীকৃতি যা নির্দেশ করে যে একটি পণ্য নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকায় উৎপাদিত- এবং তার স্বাদ, গুণ, খ্যাতি ওই এলাকার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। জিআই স্বীকৃতি পেলে ওই নামটিকে শুধুমাত্র সেই জায়গায় উৎপাদিত পণ্যই গ্রহণ করতে পারে, অন্য কোথাও তৈরি হলে “নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি” নাম ব্যবহার করতে পারবে না। এই ব্যবস্থাটি পণ্যের খ্যাতি রক্ষা করে, নকল থেকে বাঁচায়, এবং স্থানীয় উৎপাদকদের সুরক্ষা দেয়।

জিআই পণ্যের যেসব সুবিধা
• নাম ও ব্র্যান্ড সুরক্ষা
• মানদণ্ড মেনে উৎপাদন নিশ্চিত করা
• বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি সুযোগ
• স্থানীয় উৎপাদকদের লাভ বৃদ্ধি

Balish Misti Inner 2

বালিশ মিষ্টি ।। ছবি: সংগৃহীত

দেখতে কেমন?
বালিশ মিষ্টি দেখতে অনেকটা ছোট বালিশের মতো আকৃতির—চওড়া ও চ্যাপ্টা।

আকার: মাঝারি থেকে বড়, চ্যাপ্টা গঠন।
বাহ্যিক অংশ: মসৃণ ও নরম।
ভিতরের গঠন: স্পর্শ করলে নরম, ভিতরে বেশ একটু সিরার মিশ্রণ পাওয়া যেতে পারে।

রঙ ও গুণ: হালকা ক্রীম রঙ বা সামান্য সোনালি ছোঁয়া থাকতে পারে; গুণগত মান বজায় রাখতে বাইরের দিকে অতিরিক্ত শক্ত হওয়া উচিত নয়।

মিষ্টিটি খেলে প্রথমে বাইরে নরম স্পর্শ পাওয়া যায়, কিন্তু ভিতরে ছানার স্বাদ ও পার্থক্য অনুভূত হয়। ভালো মিষ্টিতে ভোক্তারা স্পর্শ, গন্ধ ও স্বাদ—সব দিকেই তৃপ্তি পান।

কীভাবে তৈরি হয় — রেসিপি ও প্রণালী

দুধ ও ছানা প্রস্তুতি
প্রথমে দুধ ভালোভাবে ফোটানো হয় এবং পরিমাণমতো অ্যাসিড (যেমন দই বা লেবুর রস) দিয়ে ছানা আলাদা করা হয়।
ছানাকে ছেঁকে পানি ঝরে যেতে দেওয়া হয়।

ছানা মসৃণ করা
ছানাকে হাতে বা হালকা মেশিনে মসৃণ করে মেখে নেওয়া হয়, যাতে শক্ত ভাব না থাকে।

আকৃতি দেওয়া
মসৃণ ছানাকে বালিশ আকৃতিতে গঠন করা হয় — সাধারণত হাতে ছুঁয়ে চ্যাপ্টা আকার দেওয়া হয়।

চিনি সিরা তৈরি ও ডুবিয়ে রাখা
একটি সিরা তৈরি করা হয় — চিনি ও পানির মিশ্রণ, মাঝে মাঝে এলাচ, হালকা রস কিংবা ক্ষীর (কনসেন্ট্রেটেড দুধ) মেশানো হতে পারে।
ছানার গঠিত বালিশগুলো সেই সিরায় ডুবিয়ে রাখা হয় নির্দিষ্ট সময়।
সিরাটির তাপমাত্রা ও সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ — অনেক বেশি গরম হলে ছানা শক্ত হতে পারে, কম হলে বেশি গলে যেতে পারে।

সার্ভ ও স্টোরেজ
প্রস্তুতির পরে মিষ্টি ঠান্ডা হতে দেওয়া হয় এবং তারপর পরিষ্কার, ঢাকনাযুক্ত কন্টেইনারে রাখা হয়।
ভালো প্রস্তুতি থাকলে মিষ্টি একপাশ থেকে বেশি শক্ত হবে না।

এই প্রক্রিয়া অনেক পুরনো হালুই পরিবার-সূত্রে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পৌঁছেছে। কিছু দোকান এখন আধুনিক যন্ত্র ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ঘর ব্যবহার করেও কাজ করছেন—তবে স্বাদ ও গুণ ধরে রাখতে ঐতিহ্যবাহী উপাদান ও পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম।

Goyanath

গয়ানাথ ঘোষ ।। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাস ও উদ্ভাবন
বালিশ মিষ্টির উৎপত্তি প্রায় একশ’ বছরের পুরনো। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত গল্পমতে, গয়ানাথ ঘোষ নামের এক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বারহাট্টা থেকে এই মিষ্টির প্রচলন শুরু করেছিলেন। তিনি একটি বড় আকারের ছানা মিষ্টির নতুন ধরণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন; সেই প্রচেষ্টায় যে মিষ্টিটি জন্ম নিয়েছিল, সেটিই আকৃতির কারণে “বালিশ” নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে তার উত্তরসূরি ও অন্যান্য হালুই পরিবারগুলি এই রেসিপি ও পদ্ধতি ধরে রাখে ও বিস্তৃত করে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ঘোষ পরিবারের অনেকেই ভারতে চলে যায়। কিন্তু গয়ানাথ ঘোষ যাননি। এই মিষ্টির গোপন রহস্য তিনি কাউকে শিখিয়ে যাননি। কিন্তু পরিবারের টানে বালিশ মিষ্টির উদ্ভাবক গয়ানাথ ঘোষ ১৯৬৯ সালে ভারতে চলে যান। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি কুমুদ চন্দ্র নাগের কাছে বিক্রি করেন। কুমুদ ছয় বছর পর বালিশ তৈরির প্রধান কারিগর নিখিল মোদকের কাছে তা বিক্রি করেন। নিখিলের মৃত্যুর পর এটি পরিচালনা করেন তার তিন ছেলে বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক। একসময় শুধু গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারেই এটি তৈরি হতো, তাই স্থানীয়ভাবে নাম হয়ে গিয়েছিল ‘গয়ানাথের বালিশ।’ এখন নেত্রকোণার অন্যান্য মিষ্টির দোকানেও এটি পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য, ১৯৮৬ সালের ২৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে বার্ধ্যক্যজনিত কারণে প্রয়াত হন গয়ানাথ ঘোষ। বাংলাদেশে দোকানটি চালিয়ে যান মোদক পরিবার ও তাদের উত্তরসূরিরা।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বিয়েবাড়ি, জন্মদিন, ধর্মীয় উৎসব বা সাধারণ বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় বালিশ মিষ্টি প্রায় অনিবার্য। অতিথি আপ্যায়নে এটি একটি সম্মানসূচক উপহার।
জেলার ছোট ও মাঝারি মিষ্টির দোকানগুলোতে বালিশ মিষ্টি বিক্রি অনেক বেশি। এভাবে মিষ্টি ব্যবসায়ীরা অর্থোপার্জন করেন, দুধ উৎপাদনকারীরাও লাভ পায়।

Balish Misti Inner 3

বালিশ মিষ্টি ।। ছবি: সংগৃহীত

জিআই স্বীকৃতির সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ

সুফল
মান রক্ষা ও নাম সুরক্ষা: “নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি” নামটি শুধুমাত্র অনুমোদিত মানদণ্ড পুরণ করলে ব্যবহার করা যাবে।
বাজার সম্প্রসারণ: দেশের অন্য এলাকায় পাঠানো ও বাইরে রপ্তানির মাধ্যমে নতুন বাজার পাওয়া সম্ভব।
উৎপাদকদের লাভ বৃদ্ধি: উৎপাদন বাড়ানো ও ব্র্যান্ড মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ।
সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ: স্থানীয় মানুষ তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারবেন ও গর্ব অনুভব করবেন।

চ্যালেঞ্জ
কাঁচামালের মান ও সরবরাহ: ভালো দুধ, পরিষ্কার পানি ও স্বচ্ছ উপকরণের সরবরাহ চালু রাখতে হবে।
মান নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শন: প্রতিটি উৎপাদককে নিয়মিত মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণের আওতায় আনা উচিত।
পরিবহন ও সংরক্ষণ: প্যাকেজিং, স্থানীয় ও দূরবর্তী বাজারে পৌঁছে দেওয়া এবং পরিবহনের সময় টাটকা রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি দরকার।
ব্র্যান্ডিং ও বিপণন: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন বিক্রয় ও ব্র্যান্ড হিসেবে প্রচার কার্যকরভাবে করতে হবে।

Balish Misti Inner 4

বালিশ মিষ্টি ।। ছবি: সংগৃহীত

শেষকথা
নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি কেবল এক টুকরো মিষ্টি নয়—এটি এক শতবর্ষের গল্প, প্রজন্মের ভালোবাসা আর স্বাদের উত্তরাধিকার। জিআই স্বীকৃতি সেই গল্পকে নতুন অধ্যায়ে নিয়ে গেছে।
যে মিষ্টি একসময় কেবল নেত্রকোণার হাট-বাজারে পরিচিত ছিল, আজ তা দেশের গর্ব হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে এই স্বাদকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার।