বুধবার । ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
নিয়াজ মাহমুদ সাকিব ফিচার ৮ অক্টোবর ২০২৫, ৬:৪৮ অপরাহ্ন
শেয়ার

মুদ্রার ইতিহাস: কয়েন থেকে ক্রিপ্টো


Coin coevrt
মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে টেকসই এবং সর্বজনীন আবিষ্কারগুলোর একটি হলো মুদ্রা। এটি শুধু লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির প্রতিফলন।
ধরুন, গ্রামীণ বাংলার এক কৃষক যেন ধান ও পাট বিনিময় করতে পারে, সে জন্য বার্টার (সরাসরি বিনিময়) পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাইলেন, সাময়িক কাজে লাগলো। কাউকে সে ধান আর পাট ধরিয়ে দিয়ে তাঁর অন্য যা যা প্রয়োজন ছিল, সব নিয়ে নিলো। এই তো! সুন্দর! কিন্তু সবসময়ই যে প্রয়োজনমাফিক জিনিসপত্র পাওয়া যাবে এমন তো কোনো কথা নেই। বাজার যত বড় হলো, সীমিত পণ্য সংখ্যা সরাসরি বিনিময় উপযোগী রইলো না।

Coin inner 5

আরেকটু ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা যাক।
এক দুপুরে, আজিজ আলি তাঁর ধান দিয়ে ডাল কিনছেন, কিন্তু ডাল বিক্রেতার প্রয়োজন ছিল লবণ- এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষই চাপে পড়তেন। প্রয়োজনই উদ্ভাবনের জনক বলতে যে কথা আছে, এই কঠিন বাস্তবতাই ছিল মুদ্রার উদ্ভবের জনক।
প্রয়োজন হলো এমন একটি বিনিময় মাধ্যমের যা সহজে ব্যবহারযোগ্য, বহনযোগ্য, এবং মূল্য সংরক্ষণশীল।
সময়ের পরিক্রমায় মুদ্রা রূপ বদলেছে- বার্টার থেকে কয়েন, কাগজ থেকে ক্রিপ্টো পর্যন্ত এই যাত্রা আমাদের অর্থনীতি ও সমাজকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছে।

প্রাচীন বিনিময় ব্যবস্থা
সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে “বার্টার সিস্টেম” ছিল লেনদেনের প্রধান ভরসা। শস্যের বিনিময়ে পশু, লবণের বিনিময়ে কাপড়-এভাবে প্রয়োজন মেটানো হতো। কিন্তু সমস্যাও ছিল গুরুতর। যদি গবাদি পশু বিক্রি করতে চান, কিন্তু বিপরীতে ক্রেতার কাছে আপনার প্রয়োজনীয় শস্য না থাকে- তাহলেই অচলাবস্থা। এই সীমাবদ্ধতাই মানুষকে স্থায়ী এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বিনিময় মাধ্যম খুঁজতে বাধ্য করে।

Coin inner 4

 

শুরুতে, মানুষ শস্য, পশু, লবণ, গবাদি পশু ইত্যাদি পণ্যের মাধ্যমে সরাসরি আদানপ্রদান করতেন।
পরবর্তীতে, এলো “কমোডিটি মানি” (commodity money)- যেমন গয়ের রূপা, গবাদি পশু, যদি মূল্য বৈশিষ্ট্য পূরণ করতো – গ্রহণযোগ্যতা, স্থায়িত্ব সাপেক্ষে তা-ই মাধ্যম হয়ে উঠতো।
যেমন, শাঁস (cowrie shell) তৎকালীন অনেক সমাজে মুদ্রার ভূমিকা নিয়েছিলো। (সূত্র: গবেষণাপত্র- “Barter, Banknotes and Bitcoin” INX One Platform)
তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা ছিল। পরিমাপ ও মান নির্ধারণ কঠিন ছিল, পণ্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকতো, এবং বহনযোগ্যতা বিবেচনায় উল্লেখযোগ্য সমস্যা ছিল তথা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হতো।

ধাতব মুদ্রার উদ্ভব ও প্রসার

Coin inner 7
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে লিডিয়ার রাজ্য প্রথমবারের মতো মানসম্মত ধাতব মুদ্রা প্রচলন করে। সোনা, রুপা বা তামা দিয়ে তৈরি ওই কয়েন শুধু লেনদেনই সহজ করেনি, বরং রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও বৈধতার প্রতীক হয়ে ওঠে। মুদ্রায় খোদাই করা প্রতীক বা সম্রাটের মুখচ্ছবি মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতো। এই সময় থেকেই অর্থনীতি ধীরে ধীরে জটিল এবং সংগঠিত রূপ নিতে শুরু করে। হাতুড়ি দিয়ে ধাতব স্ক্র্যাপ বা পিসের উপর আঘাত করে কয়েন তৈরি করা হতো। এই কয়েনগুলো স্থানীয়ভাবে তৈরি হতো এবং নির্দিষ্ট দেশের সরকার দ্বারা জারি করা হতো।
– মুদ্রাগুলোর ওজন ও ধাতুর বিশুদ্ধতা নির্ধারিত থাকতো । ফলে, বাজারে ভারসাম্য, ঐক্য ও আস্থা বজায় থাকতো।
– ধাতব মুদ্রা এবার আর শুধু লেনদেনেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, শাসকের মুখচিত্র আর প্রতীকি নকশার ব্যবহার ও শুরু হলো ধাতব মুদ্রার উপরে।

তবে এই পর্যায়ে ধাতব মুদ্রার সার্বজনীনতা ও মুদ্রা ব্যবস্থার উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করে সবাই। এ কারনেই অর্থ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ‘একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ থাকা দরকার’ এমন ধারণা পোক্ত হয়।

কাগজ মুদ্রার আবির্ভাব
মুদ্রার ইতিহাসে এক বিপ্লব আনে চীনে। তাঙ্গ রাজবংশ থেকে (সপ্তম শতকে) প্রথমবার কাগজের টাকার ধারণা পাওয়া যায়, তবে সে ধারণাই বাস্তব হয়ে সরকারি স্বীকৃতি পায় সঙ রাজবংশের শাসনামলে। প্রথমে ব্যবহার শুরু হয় প্রতিশ্রুতি নোট ((promissory notes)। পরে সরকার নিজেই কাগজ মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। ভারী ধাতব মুদ্রার তুলনায় বহনযোগ্য এই কাগুজে মুদ্রা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইউরোপে কাগজের মুদ্রা পৌঁছায় আরও পর- সপ্তদশ শতকে—ব্যাংকনোট আকারে। এখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক ব্যাংকিং ও মুদ্রা ব্যবস্থার ভিত্তি।

Coin inner 2

– Investopedia-এর তথ্যমতে, মূলত ইউয়ান রাজবংশ ১২৬০ খ্রিস্টাব্দের দিকে কাগজকে মুদ্রায় রূপান্তর করে এবং নতুন মুদ্রাব্যবস্থা প্রচলনের প্রচেষ্টা চালায়।
– ইউরোপে সপ্তদশ শতকে ব্যাংকনোট চালু হয় এবং ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী কাগুজে মুদ্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় জনপ্রিয়তা পায়।
-পরবর্তীতে, সরকার কর্তৃক প্রমিত ও তৈরি কাগজের টাকা আইনি দরপত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যা বিনিময়কে আরও সহজ করে তোলে। ( the only unverified info)

কাগজ মুদ্রার সুবিধা ছিল- হালকা, বহনযোগ্য ও মান নির্ধারণে নমনীয়তা। তবে একই সাথে আস্থা রক্ষা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

আধুনিক ব্যাংকিং ও ফিয়াট মানি
উনবিংশ শতক পর্যন্ত বিশ্বের অনেক দেশ স্বর্ণমান বা Gold Standard-এর উপর নির্ভর করতো। অর্থাৎ, মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো সোনার মজুদের ভিত্তিতে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়। বিংশ শতকে বেশিরভাগ দেশ “ফিয়াট মানি” ব্যবস্থা গ্রহণ করে নেয়-অর্থাৎ, মুদ্রার মান আর কোনো ধাতুর সাথে বাঁধা রইলো না, বরং জনগণের আস্থা ও সরকারের ঘোষণাই হবে মুদ্রা ব্যবস্থার ভিত্তি। এবং এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকই থাকবে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের মূল কর্তৃপক্ষ।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে বিশ্বব্যাপী “স্বর্ণমান (Gold Standard)” প্রচলিত ছিল – অর্থাৎ মুদ্রার মান সোনার রিজার্ভের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল।
কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে বহু দেশ এই ব্যবস্থা থেকে সরে আসে।
বর্তমানে অধিকাংশ দেশে ফিয়াট মানি (সরকার অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক মুক্ত ঘোষিত মুদ্রা) ব্যবহৃত হয়- যার মান শুধুই রাষ্ট্র ও জনগণের আস্থার ওপর নির্ভর করে। ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক রূপে ফিয়াট অর্থ ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেশি।

ডিজিটাল অর্থনীতি ও নগদবিহীন লেনদেন

Coin inner 3
শুধু কাগজের টাকায় অর্থনীতির চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। একবিংশ শতকে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার এবং পরবর্তীতে মোবাইল ব্যাংকিং এক নতুন যুগের সূচনা করে। এখন এক ক্লিকেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অর্থ পাঠানো সম্ভব। অর্থনীতি হয়ে উঠলো দ্রুত, নগদবিহীন এবং বিশ্বায়িত।
বর্তমানে অনলাইন পেমেন্ট, মোবাইল ওয়ালেট এবং ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তেই লেনদেন করা যায়।
নগদ অর্থ আর একমাত্র অর্থ না – অধিকাংশ লেনদেনই ডিজিটাল রূপ নিয়েছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির আবির্ভাব
সবশেষে, ২০০৯ সালে বিশ্ব দেখলো বিটকয়েনের জন্ম। ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি এই বিকেন্দ্রীভূত মুদ্রা সরকার বা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলে। আজ হাজারো ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে এসেছে- কেউ একে ভবিষ্যতের অর্থনীতি বলছেন, কেউ আবার ‘অস্থিতিশীল জুয়া’ হিসেবে দেখছেন। তবুও অস্বীকার করার উপায় নেই-মুদ্রার ইতিহাসের নতুন অধ্যায় এখন ক্রিপ্টোতে লেখা হচ্ছে।

– ব্লকচেইন প্রযুক্তির মূল ভিত্তি শুরু হয়েছিল স্টুয়ার্ট হ্যাবার (Stuart Haber) ও W. Scott Stornetta-র কাজ থেকে ১৯৯১ সালে — যেখানে তারা একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক টাইমস্ট্যাম্পিং সিস্টেম তৈরি করেছিলেন।
– এরপর ২০০8 সালে “Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System” নামে সাথোশি নাকামোতো একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ও ২০০৯ সালে বিটকয়েন চালু হয়।
– ব্লকচেইন হলো একটি বিকেন্দ্রীকৃত (decentralized) ডিজিটাল লেজার (ledger), যেখানে প্রতিটি ব্লক পূর্ববর্তী ব্লকের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে ও তথ্য পরিবর্তন করা কঠিন হয়।
– বিটকয়েনের পর Ethereum-এর মতো স্মার্ট কন্ট্র্যাক্ট (smart contracts) সক্ষম ব্লকচেইন প্রকল্প আসে, যা শুধুই মুদ্রা নয়, চুক্তি, ডেটা, অ্যাপ্লিকেশন—সবকিছু ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করতে পারে।
– ক্রিপ্টোকারেন্সি আজ একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
– (IMF) এক নিবন্ধে বলেছে, বিটকয়েনকে “ একবিংশ শতকে সোনার সমতুল্য” বলা যেতে পারে – কারন এটি উৎপাদিত হয় মাইনিং প্রক্রিয়ায় এবং যোগান সীমিত।
– বিশ্বব্যাপী ব্লকচেইন ও ক্রিপ্টো প্রযুক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে; উদাহরণস্বরূপ, অ্যাংলন ব্লকচেইন সিস্টেম বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে কিংবা SWIFT ব্লকচেইন প্ল্যান।
– অনেক দেশ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা (Central Bank Digital Currency, CBDC) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে- এটি ফিয়াট মুদ্রার ডিজিটাল রূপ হলেও ব্লকচেইন ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম।

কয়েন থেকে ক্রিপ্টো পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় মুদ্রা কেবল রূপ বদলায়নি, বদলেছে মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ, সামাজিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক কাঠামো। এই যাত্রা — বার্টার থেকে কয়েন, কাগজ থেকে ডিজিটাল, এবং অবশেষে ব্লকচেইনভিত্তিক ক্রিপ্টো – কেবল মুদ্রার রূপ বদল নয়, মানুষের বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা ও প্রযুক্তির সীমাকে পদে পদে চ্যালেঞ্জ করেছে। ইতিহাস বলছে, মুদ্রার প্রতিটি নতুন ধরণ এসেছে পুরোনোর সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য। সেই ধারা বজায় থাকলে, ভবিষ্যতের মুদ্রা হয়তো আমাদের কল্পনারও বাইরের কিছুই হতে পারে।