Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

কোরিয়া পরিস্থিতির একটি বিশ্লেষণ

south_and_north_korea_relation১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে আন্তকোরিয় সম্পর্ক পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুই কোরিয়ার সম্পর্ক একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্নায়ুযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের-পরবর্তীকালে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু কোরিয় জাতিকে বিভক্ত করে রাখেনি, এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বৈরিতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের মাধ্যমে দুই কোরিয়ায় দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে উত্তেজনা ও পারস্পরিক হুমকির বিষয়টি বারবার দেখা দিয়েছে।

কোরিয়া পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শক্তিধর কতগুলো পক্ষ। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও রাশিয়া। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই কোরিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব, সাম্রাজ্যবাদী ও অসাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শের দ্বন্দ্ব, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে আসছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে দুই কোরিয়ার সম্পর্ক আন্তঃকোরীয় সম্প্রীতির কিংবা বৈরিতার ক্ষেত্রে কখনো কখনো অনুঘটক হিসাবে কাজ করে আসছে।

chardike-ad

দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্ক অর্থাত্ দেশটিতে মার্কিন সেনার উপস্থিতি উত্তর কোরিয়ার জন্য সবসময়ই মাথাব্যথার বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য জাপান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের অনেকটা ছেদ ঘটেছে। উত্তর কোরিয়ার ব্যাপক সামরিক শক্তি বিশেষ করে আত্মস্বীকৃত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন বহিঃবিশ্বে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে পরিগণিত। এরকম একটি প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আন্তঃকোরীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

১৯৯১ সালে দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া একই সঙ্গে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করার পর তাদের মধ্যে সম্পর্কের কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন সূচির হয়, যা স্থায়ী রূপ লাভ করেনি কিন্তু বলা যেতে পারে সম্পর্কের ওঠানামা হয়েছে। আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দুই কোরিয়া পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিককালে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের মধ্যে বৈরিতার মাত্রা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি হচ্ছে ২০১০ সালের মার্চ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যুদ্ধজাহাজ উত্তর কোরিয়ায় টর্পেডোর আঘাতে সাগরে নিমজ্জিত হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে দু’জন দক্ষিণ কোরিয়ার নাবিক নিহত হয়। ঘটনাটি দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার মতো পরিবেশ তৈরি করে। পরবর্তীকালে বলা হয়ে থাকে ২০১২ সালে দেশ দু’টি পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। এই ধরনের একটি বিপজ্জনক ভয়ঙ্কর পরিবেশে দুই কোরিয়া যখন পরস্পরকে জড়িয়ে রাখছে তখনই উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি কিম জং ওন-এর কাছ থেকে একটি সংলাপের ঘোষণা আসে।

২০১৫ সালে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে বক্তব্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ে সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। যা তাত্ক্ষণিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ গত কয়েকদিন ধরে ইন্টারভিউ নামক হলিউডের সনি পিকচার কর্তৃক নির্মিত সিনেমাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে নতুন ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে সনি পিকচারের ওয়েবসাইট হ্যাকিং-এর জন্য অভিযুক্ত করে, যা উত্তর কোরিয়া সরাসরি অস্বীকার করে। তবে ছবিটির মূল বিষয়বস্তুর ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া তীব্র আপত্তি প্রকাশ অব্যাহত রাখে।

ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার উপর কতিপয় সামরিক ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপ করে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়ার সংলাপের ইচ্ছা প্রকাশ একটি তাত্পর্যপূর্ণ ইঙ্গিত, যার প্রভাব আন্তঃকোরিয়ার সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন বাস্তবতার নির্দেশ দেয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব এটিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। দেশটির একত্রীকরণ বিষয়ক মন্ত্রী উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য গঠনমূলক হিসাবে বিবেচনা করছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। ’৯০’র দশকের শেষদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে সানশাইন নীতি গ্রহণ করা হয়, যার মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যে বরফ গলেছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উত্তর কোরিয়া সফর করেছিলেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল দু’দেশের বিভক্ত পরিবারের মধ্যে পারিবারিক রি-ইউনিয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

সাম্প্রতিককালে এরকম প্রায় ১০০টি পরিবার যুদ্ধের প্রায় ৬০ বছর পর সীমান্তে সাক্ষাত্ লাভ করে। যা এক ধরনের আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য দুই কোরিয়া এ ধরনের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলেও তাদের সম্পর্কে মূলত বৈরিতার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। একদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অন্যদিকের উত্তর কোরিয়ার চলমান দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, দুই কোরিয়ার জনগণের জন্য ক্রমাগত একটি অস্বস্তির বিষয় হিসাবে বিবেচিত। এক ইতিহাস, এক ভাষা, এক জাতি কোরিয়া উপদ্বীপ, ঔপনিবেশিক শাসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল এবং স্নায়ুযুদ্ধের শিকার হয়ে ৩৮ অক্ষাংশে বিভক্ত জাতি রাষ্ট্র হিসাবে আর কতকাল অতিক্রম করবে।

একত্রীকরণের বাসনা সমগ্র কোরিয়া অঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বরাবরই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশে কোরিয়ার একত্রীকরণের বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হলেও আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের উন্নতি সবার মধ্যে আশাবাদ জাগাতে পারে। নিকট ভবিষ্যত্ বলে দেবে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং ওনের শীর্ষ পর্যায়ে সংলাপ শুরুর মনোভাবটা, কতটা আন্তরিক ও কার্যকর।

লেখক :সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়