Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা

মো. মহিবুল্লাহ, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪:

বাঙালী হিসেবে খুব অল্প যে কয়টা বিষয় নিয়ে আমরা দল-মত নির্বিশেষে গর্ব করে থাকি, আমাদের প্রিয় “বাংলা ভাষা” এবং এই ভাষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের আত্মত্যাগ নিঃসন্দেহে অন্যতম। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সুবাদে আমাদের মায়ের ভাষাটি বিশ্বজুড়ে বেশ পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার পর থেকে প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ২১ ফেব্রুয়ারী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর চতুর্থ (ভাষকসংখ্যার দিক থেকে সপ্তম) অবস্থানে থাকা ভাষাটির আশানুরূপ প্রভাব আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা এখনও পর্যন্ত সেভাবে তৈরি করতে পারি নি। যোগাযোগের আধুনিকতম মাধ্যম ইন্টারনেটেও বাংলা ভাষার দখল খুব সমৃদ্ধ নয়। এর একটা অন্যতম কারণ, বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করতে আমরা যতটা আগ্রহী, এর প্রচার-প্রসারে ততোটা নই! আশার কথা, সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ছে, বাড়ছে বাংলা ওয়েবসাইটের সংখ্যাও। কাগজে-কলমে ও ছাপার হরফে মলাটবন্দী হওয়ার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা হচ্ছে ব্লগেও। তবে শুধুই ব্যবহারে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রিয় ভাষাটির ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা ও সেগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়াটা প্রতিটি বাঙালীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। 

chardike-ad

 

যেভাবে এলো “বাংলা ভাষা”

বাংলা  দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। এক হাজার খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে বেশ কয়েকটি আধুনিক ভারতীয় ভাষার উদ্ভব ঘটে। এগুলোর মধ্যে মাগধি অপভ্রংশ মতান্তরে গৌড়ি অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত তৎকালীন “বঙ্গ” বা “বঙ্গাল” মুলুকের অধিবাসীদের কথোপকথনের ভাষাটিই “বাঙালা” নাম লাভ করে যা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বিবর্তন পেরিয়ে এখন আধুনিক “বাংলা” ভাষা হিসেবে আমরা ব্যবহার করছি।

বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বা ভাষারীতি রচিত হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। পর্তুগীজ মিশনারি পাদ্রি ম্যানুয়েল দ্য আসসুম্পসাঁউ Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes নামে বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা করেন। পরবর্তীতে ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হেলহেড নামক এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ও বাঙালীদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় কথা বলার ও লেখার নিয়ম-কানুনকে সাংবিধানিক রূপ দেন। আধুনিককালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ সুকুমার সেন, মুনীর চৌধুরী, ডঃ হুমায়ূন আজাদসহ বহু পণ্ডিত-ভাষাবিদের সংস্পর্শে বাংলা ভাষার রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ ও গতিশীল হয়েছে।

স্বীকৃতির জন্য যত আন্দোলন

সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন ইংরেজ পণ্ডিত ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হেলহেড। ১৭৭৮ সালে তাঁর লেখা “এ গ্রামার অব দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ” বইয়ে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা ফার্সির পরিবর্তে বাংলা করা হলে ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের সুবিধা হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এর প্রায় দেড়শ বছর পর ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে এক আলোচনা সভায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বাঙালী হয়ে ভারতবর্ষের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দীকে অগ্রাধিকার দেন। ওই বছর মহাত্মা গান্ধীকে পাঠানো এক চিঠিতেও তিনি একই মনোভাব ব্যক্ত করে লিখেন, “The only possible national language for intercourse is Hindi in India”. (সূত্র : রবীন্দ্র বর্ষপঞ্জী—প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৬৮, পৃঃ ৭৮); এর প্রতিবাদ জানিয়ে তখনই ভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাকে ভারতবর্ষের সাধারণ ভাষা করার দাবী তোলেন। ১৯২১ সালে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনার ভাষা করার দাবী জানিয়ে ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি দেন। পরবর্তীতে মওলানা আকরম খাঁ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আবুল মনসুর আহমেদসহ অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে রাষ্ট্রভাষার বাংলার দাবীতে লেখালেখি ও বক্তৃতা-বিবৃতি অব্যাহত রাখেন। তবে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবার দাবীটি সাধারণ জনগণের হয়ে ওঠে ১৯৪৭ সালে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর। পাকিস্তান ট্রাস্ট সিভিল সার্ভিসের একটি গেজেটে উর্দু, হিন্দী, তুর্কি, ল্যাটিন ও সংস্কৃত মোট পাঁচটি ভাষা ব্যবহৃত হলেও বাদ পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা। বিষয়টি তুলে ধরে তৎকালীন ইত্তেহাদ পত্রিকায় একটি প্রতিবাদী কলাম লিখেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি বলে বিবেচিত প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাশেম। বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে লেখাটি ব্যাপকভাবে সাড়া ফেলে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তরুণ সমাজ, শুরু হয় মায়ের ভাষার মর্যাদা আদায়ের এক অভূতপূর্ব আন্দোলন। এক বছর পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তির দাবী তোলেন ভাষা আন্দোলনের আরেক স্থপতি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। মুসলিম লীগের বিরোধিতায় এ দাবী বাতিল হয়ে গেলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। চলতে থাকে ধারাবাহিক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। টানা পাঁচ বছর সংগ্রামের পর ১৯৫২ সালে তা চরম আকার ধারণ করে। এ বছরের শুরু থেকেই আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। প্রায় প্রতিদিন সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল আর স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে পাকিস্তান সরকার ঢাকা শহরে সকল প্রকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে, কড়া নজরদারীতে রাখা হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২ (বাংলা ৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ সন) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আমতলায় (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেট) মিলিত হন। তিন ঘণ্টা সেখানে অবস্থানের পর উপস্থিত ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) অভিমুখে মিছিল বের করলে পুলিশ বাঁধা দেয় ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনাস্থলেই মারা যান আবুল বরকত (ঢাবি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র),  রফিক উদ্দীন ও আব্দুস সালাম নামে তিন তরুণ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় আরও কয়েকজনের। শোকাবহ এ ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে সব বয়সের, শ্রেণী-পেশার মানুষ, অবাক পৃথিবী অগাধ বিস্ময় নিয়ে সাক্ষী হয় ভাষা
র জন্যে একটি জাতির সীমাহীন আবেগ আর ভালোবাসার! ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়। ভাষার প্রতি বাঙালীর এই আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং স্ব-স্ব মাতৃভাষার প্রতি পৃথিবীজুড়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে জাতিসংঘের সহযোগী সংগঠন ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষার্থেই আরও একটি রক্তঝরা আন্দোলন হয়েছিল আসামে। অসমিয়া ভাষার আগ্রাসন থেকে নিজেদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন সেখানাকার বাঙালীরা। আসামের প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামে সকাল-সন্ধ্যা ধর্মঘটের ডাক দিয়ে শিলচরের একটি রেলস্টেশনে রেলপথ অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাঁদের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই  প্রাণ হারান নারীসহ অন্তত ১১ জন ভাষাবিপ্লবী, আহত হন অর্ধশতাধিক। সৃষ্টি হল বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের আরেকটি ইতিহাস। এবারেও বাঙালীর আত্মত্যাগ বৃথা যায় নি, আসাম সরকার বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে।

ভৌগোলিক বিস্তৃতি

বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বভাগের বঙ্গ বা বাংলা নামক অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা। এ অঞ্চলটি বর্তমানে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে বিভক্ত। বাংলাদেশের প্রায় ৯৮% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এর বাইরে বহির্বিশ্বে প্রবাসী কিংবা অভিবাসী হিসেবে অবস্থানরত বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাও প্রায় দুই কোটির কাছাকাছি হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ভাষাভাষীর দিক থেকে বাংলাভাষীরা প্রথম সারিতেই অবস্থান করছেন। সবমিলিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ইতোমধ্যে তিরিশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে বলে আশা করা যায়।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এছাড়াও ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম।ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা বাংলা, আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে স্বীকৃত সরকারি ভাষা বাংলা। ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেরও অন্যতম প্রধান স্বীকৃত ভাষা বাংলা। এদের বাইরে আফ্রিকান রাষ্ট্র সিয়েরালিওন সে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনন্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ বাংলাকে তাঁদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

এত রক্ত আর প্রাণের দামে কেনা অমূল্য ভাষাটির সম্মান, মর্যাদা আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পারছি সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। পৃথিবীর অনেক দেশই এখন নিজেদের মাতৃভাষায় রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান চর্চা সবই করছে। অথচ ভাষার জন্যে জীবন দিয়ে দেয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত শুধু বাংলাভাষীদেরই আছে। এমন একটি ভাষা শুধু আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি নিয়ে পড়ে থাকাটা খুবই দুঃখজনক! সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইন পাশ হয় ১৯৮৭ সালে। কিন্তু তা এখনও ফাইলবন্দীই রয়ে গেছে। প্রশাসন, শিক্ষাক্ষেত্র ও অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন করতে হলে প্রচলিত আইনসমূহের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং প্রয়োজন মত নতুন আইন, বিধি ও বিজ্ঞপ্তি জারি করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছার পাশাপাশি জনগণেরও তরফেও স্বতঃস্ফূর্ত দাবী আসা দরকার।

তবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশের অধিবাসী হিসেবে এখনই মাতৃভাষায় পুরোপুরি নির্ভরশীল হওয়ার চিন্তাটা আমাদের জন্যে বিলাসিতাই বটে! বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজী ভাষার এখনও পর্যন্ত কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসে কর্মরত জনশক্তি। অত্যধিক জনসংখ্যার এই দেশে মানবসম্পদই আমাদের মূল সম্পদ। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে এদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলার পাশপাশি ভাষাজ্ঞানেও যথেষ্ট শিক্ষিত করে তোলা আবশ্যক। মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক জায়গাতেই শুধুমাত্র ভালো ইংরেজি না জানার কারণে আমাদের শ্রমিকরা যোগ্যতা অনুসারে কাজ বা অর্থ পাচ্ছেন না। এ দিকটিতে বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরী। সুতরাং, সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের দাবী যেন কোনভাবেই আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায়।

শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাংলায় ভাষণ প্রদান আমাদের গর্বিত করে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার জোর দাবী উঠেছে এবং তা বাস্তবায়নেও কাজ করে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরাশক্তি না হওয়া পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলার আনুষ্ঠানিক স্থান করে নেয়াটা আদতে কতটুকু সম্ভব হবে সেটা সময়ই বলে দেবে, তবে বাংলাদেশ সরকার ও প্রবাসী বাঙালীদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টাটুকুই বিশাল সাধুবাদ পাবার দাবী রাখে।

অবাধ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটেও বাড়ছে বাংলা ভাষার ব্যবহার। এক্ষেত্রে প্রথম বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার “বিজয়”-এর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বাংলা ভাষার প্রচলনে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন এ কালের ভাষা সৈনিক মেহেদী হাসান খান। ২০০৩ সালে তাঁর আবিষ্কৃত বিনামূল্যের মুক্ত সফটওয়্যার “অভ্র কী-বোর্ড”ই এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বাংলা লেখার নিত্যসঙ্গী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এখন বেশিরভাগ বাংলাদেশীই বাংলায় লিখছেন। বাংলা ব্লগিংও এখন যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বাংলা অনলাইন পত্রিকা ও ওয়েব পোর্টালের সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে। গুগল, ফেসবুকসহ অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এখন সম্পূর্ণ বাংলাতেই ব্যবহার করা যাচ্ছে। সেচ্ছাসেবী বাঙালীদের নিরলস প্রচেষ্টায় খুব দ্রুতই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা উইকিপিডিয়া কিংবা গুগল ট্রান্সলেটরের মতো অত্যন্ত কার্যকর অনলাইন সেবাসমূহ।

বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে বিখ্যাত হয়েছেন এবং একই সাথে বাংলা ভাষাকেও ধন্য করেছেন এমন ব্যক্তিবর্গের তালিকাটা নেহায়েত ছোট হবে না। কালজয়ী কবি-সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি এ ভাষার রত্নভাণ্ডারকে প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ করে চলেছে এ কালের প্রজন্মও। তবে বাংলা চলচ্চিত্র, টিভি নাটক ও এ ধরণের অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট মান এখনও পর্যন্ত খুব একটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই দিকটিতে মেধাবীদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর দিকে নজর দেয়াটা জরুরী। অতি সম্প্রতি জাপানি ভাষার একটি কার্টুন ধারাবাহিক “ডরেমন”-এর হিন্দী সংস্করণ বাচ্চাদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একসময় তা আগ্রাসনের রূপ নিলে বাধ্য হয়ে সরকার বাংলাদেশে এটির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে। অথচ কার্টুনটি বাংলা ভাষায় ডাবিং করে প্রচারের দাবীটি দাবীই থেকে যায়। মাথা ব্যাথার প্রতিকার যেন এভাবে মাথা কেটে ফেলা না হয় সেদিকেও ভবিষ্যতে খেয়াল রাখতে হবে।

অবাধ ব্যবহারের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ভাষার বিকৃতিও হচ্ছে অনেক। যুগের দাবীতে চালু হওয়া এফএম বেতার ও মোবাইল ফোনের সংক্ষিপ্ত বার্তা (এসএমএস) আদান-প্রদানে ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। যদিও ভাষাকে বলা হয় প্রবাহমান নদীর মতো এবং একে বাঁধ দিয়ে রাখার যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে, তারপরও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর প্রমীত রূপটা যতটুকু সম্ভব ধরে রাখা জরুরী। এক্ষেত্রে আইন-আদালতের চেয়ে ব্যবহারকারীদের সচেতনতাটাই অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

মায়ের ভাষায় মনের ভাব প্রকাশে যতটা শান্তি ও আনন্দ পাওয়া যায়, অন্য কোন ভাষায় তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তথাপি জন্মসূত্রেই এত দামী আর মর্যাদাপূর্ণ একটি ভাষার অধিকারী হয়ে যাওয়াটা যথেষ্টই ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তারপরও একটা অভিযোগ অনেকদিন ধরেই উঠছে যে ফেব্রুয়ারী মাস এলে বাঙালী যতটা ভাষাপ্রেমী হয়ে ওঠে, অন্যান্য মাসে সেটা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। এ ব্যাপারে আমাদের আরও সজাগ হওয়াটা জরুরী। এছাড়া প্রতিনিয়ত আবিষ্কার হওয়া নিত্যনতুন প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে প্রিয় বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাটাও এমন একটি ভাষার ধারক-বাহকদের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজেদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ফাঁকে একটু একটু করে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে সচেষ্ট হই, তাহলে কাজটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। সবসময় মনে রাখা উচিৎ এই ভাষাই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সুতরাং এর সমৃদ্ধি, উন্নতি ও স্বীকৃতি মানেই আমাদের সমৃদ্ধি, উন্নতি ও স্বীকৃতি। চলুন না ভাষা আন্দোলনের ষাট বছরে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকেই একেকজন একালের ভাষাসৈনিক হবার শপথ নেই! মাতৃভাষার শুদ্ধ ও প্রমীত ব্যবহার নিজে জানি, অন্যকে জানাই; মায়ের ভাষার রূপ, ঐশ্বর্য পৃথিবীর শত কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হই। বিশ্বাস রাখুন, কোনরূপ রাজনৈতিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছাড়াই এই আমি-আপনি, আমরাই পারি আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা বাংলাকে বিশ্ব দরবারে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে!