ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম মালানা। বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় কুল্লু ভ্যালির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই অবস্থিত এই প্রাচীন গ্রামটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উচুতে গ্রামটি অবস্থিত হওয়ার পরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রয়েছে এই গ্রামের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। কিন্তু কিসের টানে এই সম্পর্ক রচিত হয়েছে তার ব্যাখ্যা আর ধীরে ধীরে বর্ননায় যাচ্ছি। কুল্লু ভ্যালির মোট তিনটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এই গ্রামটি দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে এক দীর্ঘ সবুজ কোনো গ্রাম।
তিন পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ার পরেও এই গ্রামে প্রবেশের সবচেয়ে সহজ রাস্তাটি হলো জারি নামক স্থান থেকে ট্যাক্সি করে যাওয়া। তবে আপনি চাইলেই এই গ্রামে প্রবেশ করতে পারবেন না। জারি দিয়ে প্রবেশের আগে স্থানীয় সেনাকর্তৃপক্ষকে আপনার আগমনের হেতু এবং পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্ত দিয়েই তবে যেতে হবে। আপনার আগমনের কারণে সন্তুষ্ট না হলে আপনাকে যেতে দেয়া হবে না ওই গ্রামে। তাই মালানায় যাওয়ার আগে অবশ্যই আপনাকে কারণ ঠিক করেই যেতে হবে।
মালানাকে ধরা হয় বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক কাঠামোর গ্রাম। এর অবশ্য কারণও আছে। এই গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস তারা মূলত গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বংশধর। সেই হিসেবে তাদের জীবনাচারণ থেকে শুরু করে সার্বিক কাঠামোই গড়ে উঠেছিল গ্রীক কাঠামো অনুসারে। এর বাইরেও মালানার রয়েছে সতন্ত্র আরেক পরিচয়। মাদকদ্রব্যের মধ্যে বিশ্বে চরস খুবই বিখ্যাত। হিমালয়ের এই অঞ্চলে উৎপাদিত গাঁজা থেকে তৈরি করা চরস পৃথিবীবিখ্যাত। আর এই কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ এই গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার চেষ্টা করে। মালানা গ্রামবাসীর মূল অর্থনৈতিক উৎসও এই মাদক ব্যবসা।
যদি কেউ এই গ্রামে ঘুরতে যান, তাহলে তার উচিত হবে গ্রামের কোনো কিছু না ছোয়া। এমনকি গ্রামের দেয়ালগুলোও ছোয়া ঠিক নয়। আর যদি মনের ভুলেও কোনোকিছু আপনি ছুয়ে ফেলেন তাহলে নির্ঘ্যাৎ আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে। এমনকি এই গ্রামের মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য সতন্ত্র এক ভাষার জন্ম দিয়েছে, যাকে তারা ‘কানাসি’ নামে ডাকে। তাদের আভ্যন্তরীন বক্তব্য যাতে বর্হিঅঞ্চলের মানুষ বুঝতে না পারে তাই এই ভাষার সৃষ্টি করা হয়েছিল।
মালানাবাসীদের ধর্মবিশ্বাস নিয়েও আছে অনেক গল্প। প্রচলিত কোনো ধর্ম বিশ্বাসে তারা বিশ্বাসী নয়। তাদের একমাত্র দেবতার নাম ‘জমলু ঋষি’। হিন্দু পুরানগুলোতে এই ঋষির নাম পাওয়া যায়। তাই ধারণা করা হয়, মালানাবাসী এখনও আর্য পূর্ববর্তী সময়ের সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। গোটা গ্রাম ঘুরে জমলু ঋষির কোনো বিগ্রহ বা মন্দির খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু প্রায় প্রত্যেকের ঘরেই রয়েছে জমলু ঋষি প্রণীত কোনো বানী বা মুর্তি রয়েছে। তবে মালানাবাসীর মধ্যে শিবের অনেক প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই গ্রামে উৎপাদিত হাসিস বিশ্বের মাদক জগতে বেশ বিখ্যাত। ১৯৯৪ এবং ১৯৯৬ সালে পরপর দুবার বিশ্বের সবেচেয়ে ভালো এবং দামি হাসিস উৎপাদনের রেকর্ডটিও মারানাবাসীর দখলে। গাঁজার সবচেয়ে ভালো প্রজাতিটিই এই অঞ্চলে জন্মায় এবং মালানাবাসীরা নিজস্ব পন্থায় এই গাঁজাকে প্রক্রিয়াজাত করে। বিভিন্ন দেশের মাদকসম্রাটরা মালানা থেকে হাসিস তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া জেনে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বলেও জানা যায়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি প্রায় ১২জন পর্যটকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল কুল্লু ভ্যালির পাদদেশে। ধারণা করা হয়েছিল, ওই পর্যটকেরা সবাই আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের অংশ এবং তারা মালানাবাসীকে হাসিস উৎপাদনের ব্যাপারে জোরাজুরি করার কারণেই তাদের ওই পরিণতি হয়েছিল। যদিও ওই ঘটনায় ভারত পুলিশ কর্তৃপক্ষ মালানাবাসীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।(বাংলামেইল২৪)